প্রধান শিরোনামবিশেষ প্রতিবেদন

আগের মতো ফ্লাইট নেই, প্রতিষ্ঠানের আয়ও নেই, বিমানের ক্রুদের দুর্বিষহ জীবন

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ আগের মতো ফ্লাইট নেই, প্রতিষ্ঠানের আয়ও নেই। এই অজুহাতে দু-একটি বাদে বন্ধ হয়েছে প্রায় সব ভাতা। কাটা-ছেঁড়ার পর মাসিক বেতনের পরিমাণ ঠেকেছে তলানিতে। স্বাভাবিক জীবন-যাপন তো দূরের কথা, মাস শেষে বাড়িভাড়া দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ক্রুরা। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে এয়ারলাইন্স প্রশাসনের নির্দেশনা অনুসারে, বিমানবন্দরের আশপাশে বাড়িভাড়া নেয়ার দুশ্চিন্তাও।

বিশ্বের সম্মানজনক ও শীর্ষ শ্রেণির পেশার মধ্যে ‘কেবিন ক্রু’, ‘স্টুয়ার্ড’, ‘এয়ার হোস্টেস’ পদবির চাকরি অন্যতম। আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে যারা বিমানের এই পদগুলোতে যোগদান করেছিলেন তারা এখন হতাশ হয়ে পড়েছেন। জীবনযাপন করছেন অস্বস্তি নিয়ে।

বিমানে পাঁচ বছর ধরে চাকরি করেন, এমন একজন কেবিন ক্রু (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক- ১) বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সব কাটার পর মাসে বেতন পাই প্রায় ২২ হাজার টাকা। অথচ মাসের বাড়িভাড়া ও সার্ভিস চার্জ বাবদই খরচ হয় ২৫ হাজার টাকা। গত কয়েক মাস ধরে সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে বাড়িভাড়া পরিশোধ করেছি। সেই টাকাও শেষের পথে।

বহরে ১৮টি উড়োজাহাজ নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানটি কর্মীদের বেতনে মাসে ৫০ কোটি টাকা খরচ করে। তবে এই খরচ কমাতে মে মাস থেকে কর্মীদের ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন কম দিচ্ছে তারা। এক অফিস আদেশে গ্রুপ ১ থেকে ৩ (২) পর্যন্ত কর্মকর্তাদের মোট বেতনের (গ্রোস স্যালারি) ১০ শতাংশ, গ্রুপ ৪ থেকে ৫ পর্যন্ত কর্মকর্তাদের ১৫ শতাংশ, ৬ থেকে ৮ পর্যন্ত কর্মকর্তাদের ২০ শতাংশ এবং ৯ থেকে ওপরের কর্মকর্তাদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেতন কর্তন করা হচ্ছে। অপরদিকে, পাইলটদের ক্ষেত্রে যাদের চাকরির বয়স ১ থেকে ৫ বছরের মধ্যে, তাদের আউট স্টেশন অ্যালাউন্স কর্তনের পর যে বেতন থাকে তার ২৫ শতাংশ কর্তন করা হচ্ছে। যাদের চাকরির বয়স ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে, তাদের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ এবং যাদের চাকরির বয়স ১০ বছরের বেশি, তাদের ক্ষেত্রে কর্তন করা হচ্ছে ৫০ শতাংশ।

পাশাপাশি ব্যয় কমাতে করোনাকালে চুক্তিভিত্তিক দেশি-বিদেশি ১৭ পাইলটকে বিনা বেতনে ছুটিতেও পাঠায় বিমান। শুধু বেতন নয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পাইলট-কেবিন ক্রুদের ৫০ ভাগ পেনশন কাটার সিদ্ধান্তও নেয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি।

পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিমানের ফ্লাইটে কর্মরত একজন ফ্লাইট স্টুয়ার্ড (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক- ২) জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুলাইয়ের বেতন থেকে করোনার কারণে নগদ ৪২০০ টাকার মতো কেটেছে। কয়েকটি ভাতা বন্ধ করায় গত মাসে মাত্র ২৪ হাজার টাকার মতো বেতন পেয়েছি। এই টাকা দিয়ে বাড়িভাড়া দেব কীভাবে? সন্তানদের খরচ মেটাব কীভাবে?

করোনাকালে দীর্ঘদিন ফ্লাইট বন্ধের পরে বেশ কয়েকটি রুটে চলাচল শুরু করেছিল বিমান। তবে যাত্রী সংকটসহ নানা কারণে অনেক রুটে ফ্লাইট স্থগিত করে তারা। বর্তমানে কয়েকটি অভ্যন্তরীণ রুটে এবং কুয়ালালামপুর, দুবাই ও লন্ডন (আন্তর্জাতিক) রুটে ফ্লাইট চালাচ্ছে তারা। তবে ২-১ দিন পরপর চলছে বিমানের বিশেষ ফ্লাইট।

বেতন, ভাতা, পেনশন কর্তনের শিকার বিমানের ক্রুদের নতুন দুশ্চিন্তার তালিকায় আছে একটি প্রশাসনিক আদেশও।

করোনা মহামারি শুরুর কয়েক মাস আগে ওই প্রশাসনিক আদেশে বিমানের পরিচালক (প্রশাসন) জিয়াউদ্দিন আহমেদ ক্রুদের জানান, অনটাইম ফ্লাইট পরিচালনার জন্য কেবিন ক্রু ও ফ্লাইট অপারেশনে সংশ্লিষ্টদের যথাসময়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য সবাইকে গুলশান, বারিধারা, নিকুঞ্জ, খিলক্ষেত, উত্তরা, আশকোনা, বসুন্ধরা, মিরপুর-১০, ১১, ১২, ১৪ নম্বর সেকশন এবং ডিওএইচএস (বারিধারা, মহাখালী, মিরপুর) এলাকায় স্ব-উদ্যোগে বাড়িভাড়া নিতে হবে।

এই আদেশ পাওয়া একজন ক্রু (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক- ৩) বলেন, দৈনন্দিন খরচ মেটাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে, এর ওপর এই অবস্থায় কীভাবে ঘর খুঁজব? বর্তমানে বাংলাদেশের দুটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স ও আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সগুলোও করোনাকালে অপারেশনে থাকা দায়িত্বরতদের অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এমন সময় বিমান উল্টো সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দিচ্ছে।

বিমানে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে কেবিন ক্রুর হিসেবে কাজ করছেন, এমন একজন নারী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক- ৪) জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের অনেক ভাতাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, বেতন কমানো হয়েছে। অথচ এভিয়েশন সংশ্লিষ্ট কোনো সরকারি দফতরে বেতন কমানোর নজির নেই।

তিনি বলেন, করোনাকালে ফ্লাইট বন্ধ ছিল বলে আমাদের ভাতা বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে এখন তো আমরা ফ্লাইটে ডিউটি করছি। এমনকি টানা ৩২ ঘণ্টাও কেউ কেউ ডিউটি করছি। তবু আমাদের ভাতা বন্ধ করে নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। শুনেছি পেনশনও অর্ধেক দেয়া হবে। এটা সম্পূর্ণ অবিচার। বারবার এসব দাবি তুললেও আমলে নিচ্ছে না বিমান। করোনাকালে অন্যান্য সময়ের চেয়ে ক্রুদের কাজ ও পরিশ্রম বেশি। অনেক বেশি ধকল নিতে হচ্ছে। লম্বা ফ্লাইট করে আমরা অনেক ক্লান্ত থাকি। কিন্তু এয়ারলাইন্সটির প্লেনের ভেতর বিশ্রামের জন্য নতুন করে কোনো স্থান বা সিট নির্ধারিত রাখা হয়নি।

অথচ সৌদি এয়ারলাইন্সসহ মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইন্সগুলো তাদের কেবিন ক্রুসহ ফ্লাইট অপারেশনের দায়িত্বরতদের জন্য এক্সিকিউটিভ ক্লাসের কিছু সিটের টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। তারা সেই সিটগুলো ফাঁকা রাখছে, যেন বর্তমান সংকটে তাদের ক্রুরা বিশ্রামের প্রয়োজন মনে করলে সিটগুলোতে শুয়ে বিশ্রাম নিতে পারে। বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করে এমন অনেক রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সও তাদের ক্রুদের জন্য এই সুবিধা রেখেছে।

যাতায়াত সুবিধা, বাড়িভাড়া ও ক্রুদের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে জানতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (প্রশাসন) জিয়াউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি, আমরা কোনো বিষয়েই কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি না। এমডি সাহেব (মোকাব্বির হোসেন) এবং পিআর সাহেব (ডিজিএম তাহেরা খন্দকার) আছেন কথা বলার জন্য, তাদের সাথে কথা বলেন। আমাদের চিঠি দিয়ে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।’

পরিচালকের কথা অনুযায়ী বিমানের এমডি ও সিইও মোকাব্বির হোসেনকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

ক্রুদের সুখ-দুঃখ নিয়ে কথা বলার জন্য বাংলাদেশ বিমান ফ্লাইং সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অব কেবিন ক্রু (বিবিএফএসএসিসি) নামে একটি সংগঠনও রয়েছে। ক্রুদের এই দুরবস্থায় করণীয় জানতে যোগাযোগ করা হয় সংগঠনের সভাপতি গোলাম দস্তগীরের সঙ্গে।

তবে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় কোনো কথা বলতে পারেননি। তিনি সুস্থ হয়ে এ বিষয়ে কথা বলবেন বলে জানান।

/এন এইচ

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close