প্রধান শিরোনামবিশেষ প্রতিবেদন

তুরাগ নদে ট্যাক্সি; উৎকন্ঠার ৪৮ ঘন্টা

রিফাত মেহেদী, বিশেষ প্রতিনিধি: রোববার (২১ জুলাই) রাত ৮ টা ১০ মিনিট। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে উভয় পাশে যানবাহনের দ্রুতগতি। এমন সময় ঢাকাগামী সাভারের আমিনবাজারে সালেহপুর ব্রিজে উঠতেই অজ্ঞাত যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় হলুদ প্রাইভেটকারটি মুহুর্তেই ঊড়ে দিয়ে পড়ে তুরাগ নদের মাঝে। এমন দৃশ্য দেখে বিপরীত পাশে থেকে জসিম উদ্দিন নামে এক যুবক রিক্সা থেকে নেমে ছুটে আসেন নদীর পাড়ে। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ৯৯৯ এ ফোন দেন। এমন কথা জানালেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গ্রাফিক্স ডিজাইনার  প্রত্যক্ষদর্শী জসিম।

তারপর ঘটনাস্থলে ছুটে আশে পুলিশ। তবে ঠিক মেলাতে পারছেন না। কারণ কোন গাড়ি পড়ে যাওয়া চিহ্ন নেই সেখানে। একটু দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে পুলিশ। কারণ নীরব জায়গাটিতে জসিম ছাড়া প্রত্যেক্ষদর্শী আর কেউ নেই বললেই চলে। এভাবে চলতে থাকে কিছুটা সময়। তারপর ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়া হয়। রাত সাড়ে ৯ টায় রাজধানীর কল্যাণপুর ফায়ার সার্ভিসের দুইটি দল ঘটনাস্থলে আসে। তারাও দ্বিধায় পড়ে। ততক্ষণে সাভার ট্রাফিক পুলিশ মহাড়কে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নিশ্চিত হন ট্রাফিক কর্মকর্তা কামরুল হাসান। হলুদ রঙ্গের প্রাইভেটকার বাসের ধাক্কায় নদীতে পড়ে যায়। এমন ভাবে উড়ে গেছে, কোন চিহ্ন থাকার কথা নয়।

দেখে নিন ভিডিও:

দেখুন কিভাবে সাভারে ট্যাক্সিক্যাবটি উড়ে তুরাগ নদে ডুবে যায়।

Posted by ঢাকা অর্থনীতি on Monday, 22 July 2019

যাই হোক, উদ্ধার অভিযানে নামার পালা। কিন্তু শুরুতেই হোচঁট। প্রয়োজন ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। খবর দেয়া হয়েছে। রাত প্রায় সাড়ে ১০ টা। ডুবুরি দলের ৫ সদস্য ঘটনাস্থলে। ততক্ষণে শতশত মানুষ তুরাগ পাড়ে। ডুবুরি দল আসলেও, নদীর স্রোতে নৌকা নিয়ে কাজ করার উপায় নেই। না এখনো উদ্ধার অভিযান শুরু করা যায়নি। এবার ফায়ার সার্ভিস খবর দিলেন স্পীডবোট। সদরঘাট থেকে রওয়ানা হয়েছে।

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। না এখনো পৌছাইনি কাঙ্খিত স্পীডবোট। গণমাধ্যমকর্মী ও স্থানীয়রা খোঁজ নিচ্ছেন কখন আসবে। ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম জানাচ্ছেন, আসার পথে কচুরিপানায় আটকে গেছে স্পীডবোট। যাই হোক অপেক্ষার পালা চলছে। এরমধ্যে টেলিভিশনের বেশির রিপোর্টার ঘটনাস্থলে। লাইভ সংবাদ প্রচার হচ্ছে। ঘুমের সময়, এমন সংবাদে দেশবাসীর চোখে পাতা যেন আটকে গেলো টিভি আর ফেসবুকের পর্দায়। সবার বুঝার চেষ্টা, কিভাবে ঘটলো ঘটনা। কোন চিহৃ নেই। নদীর তীব্র স্রোতের হুংকার, আওয়াজ শুনেই বুঝা গেল।

কচুরিপানা ছাড়িয়ে ও আলোচনা সমালোচনার মাঝে রাত সাড়ে ১২ টায় ঘটনাস্থলে আসে স্পীডবোট। কিছুটা স্বস্তি। তবে এখনো নামছেনা ডুবুরি দল। আবার অপেক্ষার পালা। নদীর পাড়ে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এভাবে ঘন্টা খানেক। তারপর বোট এলো সম্ভব্য জায়গায়।

ডুবুরি নামলেন একজন। তারপর আরও একজন। উৎসুক মানুষের ভীড় বাড়তে থাকে। মহাসড়কে চলন্ত যানবাহনে ধীর গতি। মাথা বের করে প্রশ্ন, কি হয়েছে ভাই। অপেক্ষা, আরও অপেক্ষা। ডুবুরি উঠে আসলো। না, কোন খবর নেই।

ছবি: ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল কাজ শুরু করে।

এভাবে দীর্ঘ সময়। ডুবুরিদের বিশ্রামের ফাঁকে রাত সাড়ে ৩ টায় ফায়ার সার্ভিসের দল সাভার মডেল থানার সিসি টিভির কন্ট্রোল রুমে। চিহৃত করার চেষ্টা কোন জায়গা কিভাবে পড়েছে গাড়িটি!

এভাবে রাতের আঁধার কাটিয়ে সোমবার ( ২২ জুলাই) ভোরের আলো ফুটেছে। স্থানীয় মানুষের সংখ্যা বাড়ছেই। এরমধ্যে প্রাইভেটকারের ও চালকের পরিচয় দাবী করে ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের উপ-পরিচালক ফজলুল হক নামে এক কর্মকর্তা হাজির হন ঘটনাস্থলে। নিশ্চিত করলেন, মূলত এটি ট্যাক্সিক্যাব প্রাইভেটকার। ২০১২ মডেলের টয়োটা এক্সজিও প্রাইভেটকার। চালকের নাম জিয়াউর রহমান। গ্রামের বাড়ির ফরিদপুরে। রাজধানীর পল্টনে বসবাস। এরমধ্যে নিখোঁজ চালকের স্বজনরা ঘটনাস্থলে। আর গ্রামের বাড়িতে দুই শিশু কন্যা ও স্ত্রী।

ছবি: নিখোঁজ চালক জিয়াউর রহমান ও ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস ট্যাক্সিক্যাব (প্রতীকি)

কর্মকর্তা ফজলুল হক ও চালকের স্বজন মিরাজ হোসেনের মতে, পল্টনে মাগরিবের নামাজ আদায় করে যাত্রী নিয়ে সাভারের নবীনগরে আসেন নিখোঁজ জিয়াউর। পরে যাত্রী নামিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। তারপর থেকেই মোবাইল বন্ধ। এদিকে ট্যাক্সিক্যাবে থাকা জিপিআরএস প্রযু্ক্তিতে দেখা যায়, ট্যাক্সির শেষ অবস্থান সালেহপুর ব্রিজ।

ছবি: নিখোঁজ চালকের শ্যালক নাসিম, চাচা শশুর সিরাজউল ইসলাশ ও সবশেষে ট্যাক্সি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফজলুল হকের ভিজিটিং কার্ড।

উৎসুক মানুষের নানা কথা, নানা গুজব। কেউ কেউ বলছে, এখানে রাতে চার রাস্তা দেখা যায়। এই ব্রিজের নীচে মাজার আছে। অন্য একজন সায় দিয়ে, এখানে এক কোপে পাঠা কেটে দিতে। আর কেউ বলছে, পূর্ব-পশ্চিম কোনটা। দেখে নিয়ে বললো। আমাকে ২০ মিনিট সময় দিলেই হবে। আমি বলতে পারবো। নদীর কোথায় আছে গাড়ি। এদিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সহযোগিতা করেন সাভার মডেল থানা ও ট্রাফিক পুলিশসহ নৌ পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা।

ছবি: ঘটনাস্থলে নৌ পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা।

এদিকে আবার সকাল গড়িয়ে বিকাল। উদ্ধার অভিযান চলছে বিরতি দিয়ে দিয়ে। ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয়দের মাঝে। নানা কথা, নানা যুক্তি। এরমধ্যে শেষ বিকালে হঠাৎ ট্রলার নিয়ে তুরাগ নদে নেমে পড়েন স্থানীয় একদল মানুষ। বাঁশ, রশি দিয়ে তারাও নদীর নানা স্থানে খোঁজ শুরু করে। তপ্ত রোদের শেষে পড়ন্ত বিকেল। সবার উদ্বেগ উৎকন্ঠা বাড়ছে।

ছবি: স্থানীয় মানুষ তুরাগ নদে নিখোঁজ ট্যাক্সি ও চালকের সন্ধানের চেষ্টা।

ব্রিজের পিলারের নিচে গিয়ে ট্রলার থাকা মানুষগুলো চিৎকার দিয়ে উঠেন। পেয়েছি, এখানেই আছে। আশার নতুন সঞ্চার। ব্রিজের উপরে ও নদীর পাড়ে দাড়িয়ে থাকা মানুষগুলো একযোগে চিৎকারে করে উঠে।

ছবি: গভীর রাতেও তুরাগ নদের পাড়ে অপেক্ষায় স্থানীয় মানুষ।

তারমধ্যে সন্ধ্যা ৭টায় ছোট্ট মিনিবাসে নদীর পাড়ে হাজির হন নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার সোলায়ামন কবিরের নেতৃত্বে ৯ জন ডুবুরিসহ ১১ সদস্যের একটি দল। তারা প্রস্তুতি শেষ করে ফায়ার সার্ভিসের স্পীডবোটে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। তবে ট্রলারে থাকা স্থানীয়দের খবরের সত্যতা মেলেনা। সবাই আবারও নিরাশ। এবার দৃষ্টি নৌবাহিনীর ডুবুরি দলের দিকে। অন্যদিকে নদীর পাড়ে মাঠে ক্লান্ত শরীরকে বিশ্রামে দিচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। এভাবে রাত ১ টায়। অভিযানের বিরতি।

মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) ভোরে আবারও শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। আজকে নৌবাহনীর লে. সিরাজুস সালেকিনের নেতৃত্বে দলে ৪ জন ডুবুরি সহ মোট যুক্ত হন ১৭ সদস্য। তারা মূলত সট রোপের মাধ্যমে একজন ডুবুরি নদীর তলদেশে ২০ মিটার এলাকা জুড়ে তল্লাশী করছে। নদীর তীব্র স্রোতে কাজের চ্যালেঞ্জ।

ছবি: উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যোগ দেয় নৌবাহিনী।

এভাবে চলতে থাকে। পরে দুপুর ২ টায় অভিযানে যুক্ত করা হয় নৌবাহিনীর হাইটেক টোনার সাইট স্ক্যানার মেশিন। নদীর ঘটনাস্থলের এক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে স্ক্যানার মেশিন দিয়ে শুরু হয় খোঁজ। এমন তথ্য দিয়ে দিয়ে নৌবাহিনীর চীফ পেডি অফিসার ডুবুরি কবির হোসেন বলেন, ধারনা করা হচ্ছে-ট্যাক্সি পড়ে সাথে সাথে ডুবে না গিয়ে স্রোতে ভেসে কিছুদুর গিয়ে ডুবে গেছে। এরপর স্রোতে আরো কিছু দুর নিয়ে গেছে। এছাড়া নদীর তলদেশে থাকা গর্তে ধাক্কা লেগে নদীর পাড়ে দিকে ঢুকতে পারে। তাই সব বিষয় মাথায় রেখেই স্ক্যান করা হচ্ছে।

ছবি: নৌবাহিনী হাইটেক টোনার সাইট স্ক্যানার দিয়ে কাজ করছে নৌবাহিনী।

তারপর, এভাবেই অভিযান চলতে থাকলে আশা করছে, কোন ভালো খবর দ্রুত মিলবে। কোন চিহ্ন পেলেই ডুবুরি দল নীচে নেমে পড়বেন। তবুও পরবর্তীতে প্রস্তুতি হিসেবে জায়গার এরিয়া আরও বাড়িয়ে স্ক্যান করা হবে। এদিকে থেমে নেই ফায়ার সার্ভিস দল তারা কাজ করে যাচ্ছেন নিখোঁজ চালক ও ট্যাক্সি উদ্ধারের।

নিখোঁজ জিয়াউরের স্বজনের সাথে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র‍্যাব, নৌ পুলিশ, নৌবাহিনী সকলের একটাই আশা, খুঁজে পাওয়া যাবে জিয়াউরকে। এ আশাতেই নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা।

আজ মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) রাত ৮টা পর্যন্ত এভাবেই পার হলো নিখোঁজ ট্যাক্সি ও চালক খোজার অভিযান।

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close