দেশজুড়েপ্রধান শিরোনামশিল্প-বানিজ্য

চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত চিনি আমদানি, তবু বাজার অস্বাভাবিক

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টন। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসেই দেশের সমুদ্র ও স্থলবন্দর দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে আমদানি হয়েছে পৌনে ২৩ লাখ টনেরও বেশি চিনি। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলেও বাজারে দাম বাড়ছে চিনির।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রাজধানীর বাজারে চিনি বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৮০-৮২ টাকায়। এক মাস আগেও চিনি বিক্রি হয়েছে ৭৮ টাকা কেজিতে। এক মাসে পণ্যটির দাম বেড়েছে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

দেশে চিনির আমদানির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এনবিআরের আমদানি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, চলতি অর্থবছরের এ ১১ মাসে ৮৫ শতাংশেরও বেশি চিনি আমদানি করেছে দেশের তিন বড় শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা, সিটি ও এস আলম গ্রুপ। এছাড়া ছোট পরিসরে দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড এবং আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারিও কিছু চিনি আমদানি করে। আমদানিকারক এসব প্রতিষ্ঠান মূলত অপরিশোধিত চিনি দেশে এনে পরিশোধনের পর বাজারজাত করে থাকে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন খুবই নগণ্য হওয়ায় বর্তমানে এ পাঁচ প্রতিষ্ঠানই দেশে চিনির চাহিদা পূরণ করছে।

এর মধ্যে চিনি আমদানিতে শীর্ষে রয়েছে সিটি গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা মূল্যের ৭ লাখ ৭৬ হাজার টন চিনি আমদানি করেছে। মেঘনা গ্রুপের আমদানি করা ৭ লাখ ৬৩ হাজার টন চিনির দাম ২ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। এস আলম গ্রুপ আমদানি করেছে ১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা মূল্যের ৩ লাখ ৮৯ হাজার টন চিনি। ছোট পরিসরে অবশিষ্ট চিনি আমদানি করেছে দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড। তারা ৮৯৮ কোটি টাকা মূল্যের ২ লাখ ৪ হাজার টন ও আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড ৪৪২ কোটি টাকা মূল্যের ১ লাখ ৪৬ হাজার টন চিনি আমদানি করেছে।

প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণে চিনি আমদানি করলেও বাজারে তার প্রভাব নেই। দেশের মানুষকে খুচরা পর্যায়ে প্রায় ৮২ টাকা কেজি দরে চিনি কিনতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত আন্তর্জাতিক দর, পরিবহন খরচ এসবের ওপর নির্ভর করে চিনির দাম। এ কারণে দেশের চিনির চাহিদার প্রায় শতভাগই মেটানো হচ্ছে আমদানি করে। আর সেটি করছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। এ খাদ্যপণ্যটির আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধকৃত মূল্যের অংকটিও বেশ চড়া। আবার বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সংকটের কারণে সৃষ্ট চাপ মোকাবেলায় যেখানে বিভিন্ন পণ্যের স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, চিনির ক্ষেত্রে সেটি দৃশ্যমান হয়নি।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বছরে ২০ লাখ টনের কাছাকাছি চিনির চাহিদা। অন্যদিকে দেশের রিফাইনারিগুলোর পরিশোধন ক্ষমতা বার্ষিক ৩০ লাখ টন। এছাড়া সরকারিভাবেও কিছু পরিমাণে চিনি উৎপাদন করা হয়। সব মিলিয়ে বাজারে চিনির সরবরাহ হচ্ছে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। এ অবস্থায় অর্থনীতির চাহিদা-জোগানের সূত্র অনুযায়ী চিনির বাজার আরো স্থিতিশীল হওয়ার কথা ছিল। এর পরও পণ্যটির দাম বেড়ে চলেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা চিনির দর বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববাজারের পরিস্থিতিকেই দুষছেন। ব্রাজিল, চীন ও ভারত—এ তিন দেশ রফতানিকারক হিসেবে চিনি আমদানির বড় উৎস। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশে ৮ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকার ২২ লাখ ৭৮ হাজার টন চিনি আমদানি করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করতে গিয়ে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। যার বোঝা গিয়ে পড়ছে ভোক্তাদের ওপর। যদি দেশের মূল চাহিদা স্থানীয় চিনিকলগুলোর মাধ্যমে অর্ধেকও পূরণ করা সম্ভব হতো, তাহলে ক্রেতাকে এ বাড়তি দামের বোঝা বহন করতে হতো না।

২০০২ সালের আগ পর্যন্ত বিএসএফআইসি এককভাবে চিনি উৎপাদন ও আমদানি করত। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার টন। পরের বছর (২০১৪-১৫ অর্থবছর) উৎপাদন নামে ৭৭ হাজার ৪৫০ টনে। এরপর ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন কিছুটা বেড়ে ৮২ হাজার ১৪০ টনে উন্নীত হলেও গত আখ মাড়াই মৌসুমে (২০২০-২১ অর্থবছর) সেই উৎপাদন কমতে কমতে এসে ঠেকে ৪৮ হাজার ১৩৩ টনে। ২০২০ সালে ছয়টি চিনিকল বন্ধ হওয়ার পর বড় ধাক্কা লাগে স্থানীয় উৎপাদনে। চিনিকলগুলোর লোকসানের বোঝা কমাতে ওই সময় বিএসএফআইসি এসব চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়।

চলতি অর্থবছর এখন পর্যন্ত দেশে ২৪ হাজার ৯০০ টন চিনি উৎপাদিত হয়েছে, যা সরকারি কলে উৎপাদনের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। বর্তমানে কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর (রংপুর), রংপুর ও সেতাবগঞ্জ (দিনাজপুর) চিনিকল বন্ধ হওয়ায় সেসব এলাকায় আখের উৎপাদন একেবারেই কমে গিয়েছে। আগামী নভেম্বরে তৃতীয় মাড়াই মৌসুম শুরু হবে। তবে স্থানীয় অনেক কৃষকই আখ চাষ বাদ দিয়ে অন্য ফসল আবাদ শুরু করেছেন, যা এ শিল্পের জন্য অশনিসংকেত বলেই মনে করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বাণিজ্যিক পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. আনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে বছরে ২০ লাখ টন চিনির সরবরাহ থাকলেই চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। চাহিদার এখন প্রায় পুরোটাই বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা করছেন। তাদের পরিশোধন ক্ষমতাও চাহিদা অনুযায়ী বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিনির বাজারের মূল্য স্থিতিশীল হওয়ার আপাতত কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সর্বোচ্চ চিনি উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিলের চিনিকলগুলো চিনি রফতানির চুক্তি বাতিল করে আখ থেকে ইথানল উৎপাদন করে রফতানি করতে চুক্তিবদ্ধ হতে শুরু করেছে। বিশ্বজুড়ে সব ধরনের জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় আখ থেকে উৎপাদিত বায়োফুয়েলের (জৈব জ্বালানি) চাহিদা বেড়েছে। ফলে চিনির চেয়ে আখ থেকে ইথানল উৎপাদন অধিক লাভজনক হয়ে ওঠায় সেদিকে মনোযোগ রফতানিকারক দেশের।

চাহিদা আর জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কথা জানালেন বেসরকারি খাতে চিনির সবচেয়ে বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা। তিনি বলেন, চিনির দামের বিষয়টি পুরোটাই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে আমদানিকারকদের কিছু করার নেই। আমদানিকারকরা চাহিদার বেশি চিনি আমদানি করছেন, তাদের সম্মিলিত পরিশোধন ক্ষমতাও অনেক বেশি। কিন্তু এটাও ঠিক যে তাদের বেশি দামেই চিনি কিনতে হচ্ছে। বাজারেও সরবরাহ করা হচ্ছে চাহিদা অনুযায়ী।

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close