দেশজুড়েবিশেষ প্রতিবেদন

তিন হাত মাটি নিয়েও কবর বাণিজ্য

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ জনসংখ্যার বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কবরের চাহিদা। সেই সুযোগে নিয়ম না মেনেই লাশ দাফনের জন্য নেয়া হচ্ছে বাড়তি টাকা। সিটি কর্পোরেশনের কর্মী পরিচয়ে বিভিন্ন সিন্ডিকেট কবর দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসোহারা আদায় করছে।

দুই সিটির তত্ত্বাবধানে থাকা আটটি কবরস্থানের চিত্র একই। তবে দক্ষিণ সিটির কবরস্থানগুলো লাশ দাফন থেকে সবকিছু ফ্রি থাকলেও এখানে লাশ নিয়ে চলে রমরমা বাণিজ্য।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) এলাকায় বাস করে এক কোটির বেশি মানুষ। সে হিসাবে প্রতিদিন মারা যায় অন্তত ৫০ জন। ডিএনসিসিতে রয়েছে ছয়টি কবরস্থান। সর্বোচ্চ ৫শ টাকা দাফনের ফি নেয়ার কথা থাকলেও ২ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। শুধু লাশ দাফনই নয়, কবর রক্ষণাবেক্ষণের নামেও চাওয়া হয় বাড়তি টাকা।

তথ্য অনুসারে, ডিএসসিসি এলাকায় প্রতিদিন অন্তত ৪০ জন মানুষকে কবর দেয়া হয়। পারিবারিক কবরস্থানের বাইরে এখানে রয়েছে জুরাইন ও আজিমপুর কবরস্থান। ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বর থেকে এসব কবরস্থানে লাশ দাফন বিনামূল্যে করার ঘোষণা দিয়েছে ডিএসসিসি। কিন্তু লাশ দাফনের জন্য আদায় করা হয় চার থেকে আট হাজার টাকা। আবার রক্ষণাবেক্ষেণের জন্য নেয়া হয় মাসোহারা।

রাজধানীর আজিমপুর ও মিরপুর কবরস্থান ঘুরে দেখা গেছে, কবরস্থানগুলোতে সিটি কর্পোরেশনের কর্মী নন এমন অনেকে কাজ করছেন। কেউ কবর খোঁড়ছেন আবার কেউ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন। প্রতিটি কবরস্থানে সিটি কর্পোরেশনের ৫০ থেকে ১০০ জন কর্মী নিয়োগ দেয়া থাকলেও সিন্ডিকেটের সদস্য রয়েছে ১শ থেকে ১৫০ জন। এর মধ্যে আজিমপুর কবরস্থানের ফারুক কন্ডাক্টর সিন্ডিকেট অন্যতম। নগর কর্তৃপক্ষ নিয়োগ না দিলেও তারা নিজেদের সহায়ককর্মী বলে দাবি করেন।

এসব লোক নানা কৌশলে শুধু অতিরিক্ত টাকা আদায় নয়, পুরনো কবর থেকে হাড়গোড় তুলে নিয়েও ব্যবসা করে। মৃত্যুর পর সাড়ে তিন হাত মাটি নিয়ে কবরস্থানগুলোতে চলে রমরমা ‘কবর বাণিজ্য’। এদের সঙ্গে জড়িত সিটি কর্পোরেশনের নিযুক্ত করা কর্মী ছাড়াও বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।

সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কবর খনন, লাশ দাফন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচ্ছন্নতার জন্য সিটি কর্পোরেশনের জনবল রয়েছে। তারাই কবরস্থানের দেখভাল করে। এজন্য কোনো টাকা লাগে না।

মৌখিকভাবে অন্তত দুই বছর সাধারণ কবর সংরক্ষণের কথা বলা হলেও নিয়মিত টাকা না দিলে বছর ব্যবধানে ওই সব কবরের ওপর নতুন কবর তৈরি করা হয়। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আজিমপুর, জুরাইন, মিরপুর ও উত্তরা কবরস্থানেও যাদের দাফন করা হচ্ছে, সবার ভাগ্যেই জোটে এমন পরিণতি।

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা ফরিদ উদ্দিন। তার ভাগিনা ১৯ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা গেলে আজিমপুর কবরস্থান দাফন করেন। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ কোনো টাকা না নিলেও যারা কবর খোঁড়েন তাদের চার হাজার টাকা দিতে হয়েছে। কবর পরিষ্কার ও উঁচু করার জন্য প্রতিমাসে ৫শ টাকা চেয়েছেন।

তিনি বলেন, কবরস্থানের লোকজন বললো ফ্রি, কিন্তু যারা কবর খোঁড়ছেন তারা ৫ হাজার টাকা চেয়েছেন। আমি চার হাজার টাকা দিয়েছি।

আজিমপুর কবরস্থানে বাবার কবর জিয়ারত করতে আসা জনি মিয়া সঙ্গে কথা হয়। তিনি ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, একমাস আগে বাবা মারা যায়। কবর দেয়ার সময় ৫ হাজার টাকা দিয়েছি। আর প্রতি মাসে দিতে হবে ৫শ টাকা। যাতে করে কবর ঠিক থাকে, পরিষ্কার থাকে।

তিনি আরো বলেন, সব ফ্রি, এরপরও টাকা না দিলে কবরস্থানের সামনের জায়গায় মাটি দিতে দেয়া হয় না।কবরস্থানের শেষ প্রান্তে নিয়ে মাটি দেয়া হবে, এই ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করে বলে অভিযোগ আছে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচ্ছন্নকারীদের নামে।

চার বছর ধরে আজিমপুর কবরস্থানে কবর খোঁড়েন আবদুল খালেক। তিনি বলেন, কবর খোঁড়ার জন্য আমি সিটি কর্পোরেশনের নিযুক্ত লোক নই। ফারুক কন্ডাক্টরের লোক। আমরা একসঙ্গে ৩০ জনের মতো কাজ করি।

আজিমপুর কবরস্থান কবর খোঁড়া, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার কাজ করেন আ. মোতালিব ও ইমরান। তারাও ডিএসসিসির নিযুক্ত লোক নয়। জানতে চাইলে ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, কবর খোঁড়া, লাশ দাফন, বাঁশ এবং বাঁশের চটা সবকিছু ফ্রি। আমরা কবর খোঁড়ে দেই। কেউ খুশি হয়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা দেয়।

রায়ের বাজার কবরস্থানের দায়িত্বে থাকা মাওলানা আবদুল আজিজের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, এখানে লাশ দাফন করার জন্য টাকা নেয়া হয় না। শুধু নিয়ম অনুযায়ী ৫শ টাকা জমা দিতে হয়। আর কোনো টাকা লাগে না।এর মধ্যে সব কিছু করা হয়। যারা কবর খোঁড়ে তাদের কেউ যদি খুশি হয়ে টাকা দেয়, সেটা অন্য কথা। বাড়তি কোনো টাকা দাবি করা হয় না।

আজিমপুর কবরস্থানের দায়িত্বে থাকা হাফিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের এখানে লাশ দাফন করা সম্পূর্ণ ফ্রি। কেউ খুশি হয়ে কবর শ্রমিকদের কিছু টাকা দেয়, সেটা আলাদা বিষয়। এছাড়া কোনো টাকা নেয়া হয় না। কবরের উপরে ঘাসে দেয়ার নাম করে ১ হাজার নেয়া হয় এবং কবর সংরক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ২শ থেকে ৫শ টাকা নেয়া হয়। এই বিষয় তিনি অস্বীকার করেন।

অন্যদিকে লালবাগের বাসিন্দা রফিক ইকবাল অভিযোগ করে বলেন, গত মাসে আমার মেয়ের জামাই মারা যান। আজিমপুর কবরস্থানে আমাদের জমি রির্জাভ রয়েছে। নিয়মানুযায়ী কবর পাকা করতে ১৫ হাজার টাকা জমা দেই। তবে আজিমপুর কবরস্থানের ইনচার্জ মো. হাফিজুল ইসলামকে বাড়তি টাকা না দেয়ায় কবর পাকা করার অনুমতি দেননি। পরে ৯ হাজার টাকা ঘুষ দিলেও আরো টাকা দাবি করেন।

এই নিয়ে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করা অবস্থায় রিপোর্টার হাজির হলে হাফিজুল ইসলাম নড়েচড়ে বসেন। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে কবর পাকা করার জন্য অনুমতি দেন।

গত কয়েক দিন রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থান ঘুরে কবর বাণিজ্যের এমন চিত্র পাওয়া গেছে। কবরস্থান দেখভালের দায়িত্বে থাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরশনের সমাজকল্যাণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা সঙ্গে কথা বলার জন্য ফোন দেয়া হলে একজন বলেন, এখন অফিস টাইম নেই।

কবরস্থানে দায়িত্বরত সিটি কর্পোরেশনের কোনো কর্মীর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত টাকা আদায়সহ কোনো ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রামণসহ অভিযোগ দেন।

/এন এইচ

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close