করোনাপ্রধান শিরোনামবিশেষ প্রতিবেদন

করোনা থেকে একজনের ভালো হয়ে ওঠার কাহিনি

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: মাস কয়েক আগে চাকরি বদলে কানাডা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে এসেছি আমি। এখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত পড়াচ্ছি। অপরাধপ্রবণ শহর হিসেবে পরিচিতি থাকায় এখানে স্থায়ীভাবে অনেকেই থাকতে চান না​। তবে পাহাড় আর সমুদ্রঘেরা এক অপূর্ব শহর কেপটাউন, আবহাওয়াও চমৎকার। নতুন এসে পুরোপুরি গুছিয়ে না উঠতেই ফেব্রুয়ারির শেষে কিছু গবেষণাবিষয়ক ও ব্যক্তিগত কাজে আবার কানাডায় যেতে হয় আমাকে। কাজ সেরে মার্চের ৫ তারিখে কেপটাউন ফিরি। কেপটাউনে তখনো কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত কারও খোঁজও পাওয়া যায়নি। তবে সতর্কতার জন্য এখানকার বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

ফিরে আসার কয়েক দিন পর ক্লাস নিতে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত ছিল, কারও মধ্যে ভাইরাসের কোনো উপসর্গ না দেখা দিলে কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন। তখনো একজন রোগীও পাওয়া যায়নি, তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগে কর্মীদের জন্য থার্মোমিটার ও হাত পরিষ্কার রাখার জন্য জীবাণুনাশক সরবরাহ করতে থাকে কর্তৃপক্ষ। কয়েক দিন পর বলা হলো, যাঁরা সম্প্রতি বিদেশ থেকে ফিরেছেন, তাঁদের যদি অতি সামান্য কাশি অথবা শরীরে ৩৭.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে, তাহলে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হবে না। তাঁদের করোনা টেস্ট করার চেষ্টা করা উচিত।

আমি ফিরে আসার সপ্তাহখানেক পরই সিদ্ধান্তগুলো এল। সে সময় হঠাৎ করেই হালকা শুকনো কাশি দেখা দিল আমার। আর কোনো শারীরিক সমস্যা ছিল না, এই তাৎপর্যহীন কাশি ছাড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন থেকেই বাসায় বসে কাজ করা শুরু করি।

কেপটাউনে নতুন, তাই পরীক্ষার ব্যবস্থা কীভাবে করব, স্বাস্থ্যবিমার খরচ কে বহন করবে, এসব চিন্তা করে এক দিন নষ্ট করে ফেললাম। তবে সে রাতে একটুও ঘুম হয়নি। মনে হচ্ছিল আমার থেকে তো অন্য মানুষের ছড়াচ্ছে। একটু পড়াশোনা করলাম এ নিয়ে। জানলাম উপসর্গ মারাত্মক না হলেও একজন আক্রান্ত ব্যক্তির খুব কাছে যাঁরা এসেছেন এবং আক্রান্ত ব্যক্তির ধরা দরজার হাতল ধরার মতো মামুলি বিষয়েও এই রোগ ছড়াতে পারে। কেবলই মনে হচ্ছিল, আমার হলে আমার পরিবার, যে ছাত্র আমার অফিসে এসেছিল প্রশ্ন নিয়ে, তারও তো হতে পারে। সে না জানি আবার কত জায়গায় ছড়াবে।

পরদিন সকালে পারিবারিক চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সেই সময় কেপটাউনে বিষয়টা নতুন। তাই তিনি একটু খোঁজ নিয়ে জানালেন, আমাকে কীভাবে পরীক্ষা করতে হবে। বললেন, তিনি আমাকে একটি ফরম দেবেন সেটি নিয়ে মাস্ক পরে আমাকে একটি বেসরকারি ল্যাবে গিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। ফলাফল পেতে তিন দিনের মতো লাগবে, কারণ ল্যাব আমার থেকে নেওয়া নমুনা জোহানেসবার্গে পাঠাবে। পরীক্ষার ফল আসার আগ পর্যন্ত আমাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। নেগেটিভ হলে আবার সব স্বাভাবিক হবে।

ল্যাবে মাস্ক পরে গেলাম। ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম, পরীক্ষাটি করতে বাংলাদেশি টাকায় ৭ হাজার টাকার মতো লাগবে। তবে যদি আমার ফলাফল পজিটিভ হয়, তাহলে খরচ স্বাস্থ্যবিমা থেকে পাওয়া যাবে। খুব সাধারণ, নাক ও গলার ভেতর একটা কাঠি ঢুকিয়ে তরলের স্যাম্পল নেওয়া। পরদিন ছিল শনিবার, ছুটির দিন। আমার ছেলের তার এক বন্ধুর জন্মদিনে দাওয়াত ছিল। কেপটাউনে আসার পর এটাই তার প্রথম দাওয়াত। ১০ বছরের বাচ্চার কাছে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তাকে সময় নিয়ে বোঝাতে হলো, আমরা যেতে পারছি না। তিন দিন লাগল না, দুই দিন পরই আমার চিকিৎসক ফোন করে জানালেন আমার করোনা পজিটিভ।

আমাদের দুই সপ্তাহ হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। যেহেতু আমি ছাড়া পরিবারের আর কারও মধ্যে উপসর্গ ছিল না, তাই আমাকে আলাদা ঘরে একা থাকতে হবে। সবার সঙ্গে দূরত্ব রাখতে হবে, ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। দরজার হাতলে এই ভাইরাস অনেকক্ষণ বেঁচে থাকে, তাই সেটি কিছুক্ষণ পরপর জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। আমার উপসর্গ যেহেতু খুব সামান্য, তাই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই। উনি আরও জানালেন, এনআইসিডি ও প্রভিন্সিয়াল স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে খুব তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তিনি আমাকে গত এক সপ্তাহে আমার কাছাকাছি যাঁরা এসেছেন, তাঁদের একটি তালিকা তৈরি করতে বললেন। কাছাকাছি মানে দুই মিটার দূরত্বের মধ্যে।

ফোন রেখে ১০ মিনিটের মধ্যে আমি দ্রুত কিছু কাজ সারলাম। প্রথমে আমার রিসার্চ গ্রুপ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে ই-মেইল করে জানালাম। আমার স্ত্রী বাচ্চাদের স্কুলে ই-মেইল করল। রোববার ছুটি ছিল, তাই সবাইকে ই-মেইল করতে হলো। ভাবতে বসলাম এক সপ্তাহে কারা আমার কাছাকাছি এসেছে। সরকারি সংস্থা যোগাযোগ করবে বলা হলেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমি নিজেই তাঁদের ফোন করে ঘটনা বললাম, বাসায় থাকতে বললাম। বললাম, উপসর্গ থাকলে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে যোগাযোগ করতে।

এখানে আমাদের বাসার কাজে সহযোগিতা করার জন্য সপ্তাহে একজন নারী আসেন। মূলত দিন হিসেবে তাঁকে বেতন দিতে হয়। তাঁকে ফোন করে বললাম দুই সপ্তাহ না আসতে। উনি বেশ দরিদ্র, তাই দুই সপ্তাহে তাঁকে যা দেওয়ার কথা তা দেওয়া হবে বলে জানালাম। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রভিন্সিয়াল স্বাস্থ্য দপ্তর, আমার চিকিৎসক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ফোন করলেন, তাদের আমি তালিকাটা দিলাম।

কানাডা থেকে ফেরার পর একটি গ্রুপ মিটিংয়ে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে অনেক শিক্ষক, ছাত্র ও গবেষক ছিলেন। তাঁরা যখন জানলেন আমি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত, হঠাৎ করে সবাই অসুস্থ বোধ করলেন। কারও কারও অবস্থা আমার চেয়ে খারাপ হয়ে গেল ভয়ে। কেউ কেউ বিছানা থেকেই উঠতে পারছিলেন না। পরে সবাইকে পরীক্ষা করা হলো, সবারই নেগেটিভ। এরপর কিছুটা ভালো বোধ করলাম। তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হলো। সবাইকে বাড়িতে বসে কাজ করতে বলা হলো।

এর মধ্যে আমার ছেলের একটু কাশি এবং স্ত্রীর গলাব্যথা ও কাশি শুরু হয়। ওদের করোনা টেস্ট করা হয়, তবে নেগেটিভ আসে।

চিকিৎসকেরা জানান, দুই সপ্তাহ পর আমার কোনো উপসর্গ না থাকলে আবার পরীক্ষা করা হবে। সেটি নেগেটিভ এলে দুই-তিন দিন পর আবার একটা পরীক্ষা করা হবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। দুই সপ্তাহে আমার কাশি একদম ভালো হয়ে যায়। পুরো সময়ে একদিন জ্বর আসে আমার, ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বলা যায় আমি অতি ভাগ্যবানদের একজন।

এদিকে এই দুই সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেশ বেড়ে যায়। স্বাস্থ্য দপ্তর তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে জানায়, আমাকে আর পরীক্ষা করাতে হবে না। কোনো উপসর্গ না থাকলে আর কোয়ারেন্টিনেও থাকতে হবে না। অর্থাৎ আমি ভালো গেছি। তবে আমি আরও এক সপ্তাহ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই পুরো সময়ে আমাকে প্রতিদিন একজন চিকিৎসক ফোন দিতেন। এক প্রতিবেশী সপ্তাহে দুই দিন বাজার করে বাসার দরজার কাছে রেখে যেতেন। আরেক প্রতিবেশী ফোন দিয়ে প্রায়ই জানতে চেয়েছেন কিছু লাগবে কি না।

কোভিড-১৯ অতি ছোঁয়াচে। এর প্রতিষেধক কত দিনে আসবে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার সঙ্গে এর বিস্তারের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। এখন পর্যন্ত এটি নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সত্যি বলতে এই ভাইরাসটির অনেক কিছুই নিশ্চিতভাবে আমরা জানি না। তবে যেকোনো মহামারির কিছু সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পদার্থবিজ্ঞানের একতা তত্ত্ব কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরিতে রি-নরমালাইজেশন গ্রুপ ফ্লো বলে একটা বিষয় আছে, যা দিয়ে মহামারির গাণিতিক কিছু মডেল দাঁড় করানো যায় এবং এর সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করা যায়। যাঁরা এই মুহূর্তে বাড়িতে বসে বিরক্ত হচ্ছেন, তাঁরা এটি নিয়ে পড়াশোনা করে সময় কাটাতে পারেন।

বিশ্বে এখন চলছে গ্রহণকাল। প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যার যা দায়িত্ব, করণীয়, তা সঠিকভাবে পালন করা। বেশির ভাগ মানুষের প্রধান দায়িত্ব বাসায় ধৈর্য ধরে বসে থাকা। এই ভাইরাসকে ছড়াতে দেওয়া যাবে না। দরিদ্র মানুষ, যাঁরা প্রতিটি দিন কাটে ওই দিনের উপার্জন দিয়ে, তাঁদের সহায়তায় রাষ্ট্র ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, অর্থ, বিত্ত বা ক্ষমতা দিয়ে এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। সবাই সুস্থ না হলে এই বিপদ কাটবে না।

এই ধরনের বিপদে রাষ্ট্রের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রকে একদিকে নিশ্চিত করতে হয় জনগণ যাতে আতঙ্কগ্রস্ত না হয়। আবার পরিস্থিতি হালকাভাবে নেওয়ারও কোনো অবকাশ নেই। ছোঁয়াচে মহামারির ক্ষেত্রে চেষ্টা করতে হয়, রোগটির বিস্তার কত কমিয়ে আনা যায়। রোগটি সারা দেশে না ছড়িয়ে অল্প এলাকাজুড়ে থাকলে এটির প্রতিরোধ সহজ হয়। এ বিষয়ে একটি রাষ্ট্রকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে, সেই সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে প্রত্যেককে। আজকে যদি আমরা সবাই নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করি, আমাদের জন্য অবশ্যই ভালো কিছু অপেক্ষা করবে না। সংকটকালে যারা এগিয়ে আসতে পারেন, তাঁরাই মহৎ মানুষ। দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে ঠিক কাজটি না করলে নিজেদের অস্তিত্বকেই আমরা বিপন্ন করব।

ড. সাজিদ হক: শিক্ষক ও গবেষক, ম্যাথমেটিক্স অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স, ইউনিভার্সিটি অব কেপটাউন, সাউথ আফ্রিকা

সূত্র: প্রথম আলো

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close