দেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম

ক্যাপাসিটি চার্জে যুক্ত হচ্ছে এলএনজিনির্ভর তিন বিদ্যুৎকেন্দ্র

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদন না হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে শুধু সক্ষমতার জন্য নির্দিষ্ট হারে অর্থ (ক্যাপাসিটি চার্জ) পরিশোধ করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। শুধু বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে গিয়েই প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি)। বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের এ তালিকায় নতুন করে যুক্ত হতে যাচ্ছে সামিট, ইউনিক ও রিলায়েন্সের ১ হাজার ৯০০ মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতার এলএনজিভিত্তিক আরো তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র তিনটি নির্মাণ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে। সামিট পাওয়ার, ইউনিক গ্রুপ ও ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ পৃথকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ করছে। এরই মধ্যে চলতি বছরের আগস্টে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। বাকি একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন আগামী বছরের মার্চ নাগাদ শুরুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ। সরবরাহ কমেছে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়ও। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে যাওয়া নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রস্তুত হওয়ার পর গ্যাসের অভাবে চালু করতে না পারলেও বসে থাকা অবস্থায়ই এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে বিপিডিবিকে।

সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। ব্যবহার হয় মাত্র সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। বসিয়ে রাখা সক্ষমতার বিপরীতে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই (জুলাই-মার্চ) বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে মোট ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে সরকারকে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য হলো বিশ্ববাজারে এখন এলএনজির যে দাম তাতে শিগগিরই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা যাবে না। অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য যে পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটির কাজও চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সময়মতো প্রস্তুত হলেও এসব জটিলতার কারণে উৎপাদন নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গিয়েছে।

এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানি করতে না পারায় এমনিতেই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। এছাড়া নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করার বিষয়টিও জটিলতার মধ্যে পড়েছে। স্পট মার্কেটে দাম না কমলে এবং স্থানীয় উত্তোলন বৃদ্ধি করা না গেলে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা সম্ভব নয়। তাছাড়া মেঘনাঘাটের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য যে ডেডিকেটেড পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে, তার কাজ শেষ হতে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগবে বলে আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যের আকাশচুম্বী মূল্যের কারণে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের পথ বেছে নিয়েছে সরকার। জ্বালানি খরচ কমাতে বন্ধ রাখা হয়েছে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে নতুন যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠছে সেগুলো নির্ধারিত বা এর কাছাকাছি সময়ে চালু করা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার আশু কোনো সমাধান দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্র তিনটির মূল জ্বালানি গ্যাস বা এলএনজি। কিন্তু বিশ্ববাজারে এলএনজির এখন যে দাম, তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের সংস্থান করাই এক প্রকার মুশকিল হয়ে পড়েছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম আদতে কবে নাগাদ কমবে, সে বিষয়েও স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারছে না কেউই। বরং পণ্যটির দাম সামনের দিনগুলোয় আরো বাড়বে বলে আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসে উঠে এসেছে।

বড় এ তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ দেয়ার কথা তিতাসের। বর্তমানে তিতাসের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে এলএনজি আমদানি করা না গেলে গ্যাস সরবরাহ দেয়া সম্ভব নয়। বরং বিদ্যমান যেসব গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে সেগুলোর অনেকগুলোই এখন জ্বালানির অভাবে অলস বসে রয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালুর ক্ষেত্রে আরো বড় প্রতিবন্ধকতা হলো গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন। মূলত মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ হাব এলাকায় গ্যাস সরবরাহ দেয়ার জন্য ‘বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর’ গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করছে জিটিসিএল। ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের দীর্ঘ ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে এ তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ দেয়ার জন্য। আমদানীকৃত এলএনজি গ্যাসিফিকেশনের পর মহেশখালী হয়ে কুমিল্লার বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন লাইন দিয়ে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে তা মেঘনাঘাটে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য থেকে পাইপলাইনটি নির্মাণ হচ্ছে। আর এ পাইপলাইনের নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে।

এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিতাসের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, তিতাস থেকে গত বছর তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এ লাইন নির্মাণের অগ্রগতির বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। বিদ্যমান লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা যাবে, তবে সেক্ষেত্রে অন্য সব বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করতে হবে।

এরই মধ্যে নির্মীয়মাণ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সিংহভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী কয়েক মাসের ভেতরে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির কমিশনিং সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এর মধ্যে সামিট মেঘনাঘাট-২ নামে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করছে সামিট পাওয়ার। ৫৯০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চলতি বছরের আগস্টে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির গ্যাস টারবাইন, জেনারেটর স্থাপনসহ নানা প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ইউনিক গ্রুপের ৫৮৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও চলতি বছরের আগস্ট নাগাদ উৎপাদনে যাবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার নামের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৮০ শতাংশ কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।

এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বিপিডিবির সঙ্গে নির্মাণ ও ক্রয় চুক্তি করে ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্স। ২০২৩ সালের মার্চ নাগাদ রিলায়েন্স মেঘনাঘাট ৭৫০ মেগাওয়াট আইপিপি-২ নামে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনে যাবে বলে জানিয়েছে বিপিডিবি।

এর বাইরে এলএনজিভিত্তিক আরো অন্তত ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও ক্রয়চুক্তি করেছে বিপিডিবি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবই আগামী বছর নাগাদ উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুতের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, গ্যাসভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠেছে, সেগুলো বিদ্যমান পরিস্থিতি ঠিক হলেই সমাধান হয়ে যাবে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করতে সরকার নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যেগুলো এগিয়ে চলছে। কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনক্ষম হয়ে ওঠার পর যাতে বসে না থাকে সেটি নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি খুব একটা সহজ নয়। দেশে বিদ্যমান গ্যাসের সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো। বিদ্যমান সংকট কাটাতে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানির বিকল্প পথ খোলা নেই। অন্যদিকে গ্যাস সরবরাহের বিদ্যমান অবকাঠামোও সীমিত। এ অবস্থায় নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনক্ষম হয়ে ওঠার পর তা কেবল বিপদই বাড়াবে।

সামিট, ইউনিক ও রিলায়েন্সের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে দৈনিক গ্যাসের সংস্থান প্রয়োজন ১৩ কোটি ঘনফুট। বর্তমানে এ পরিমাণ গ্যাসের সববরাহ দেয়ার মতো সক্ষমতা জ্বালানি বিভাগের নেই।

দেশে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি চাহিদা পূরণে গত বছরের অন্তত তিনটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। গত বছরের ১৬ জুন ভারতের সঙ্গে এলএনজি আমদানি করতে এইচ-এনার্জির সঙ্গে চুক্তি করে পেট্রোবাংলা। এরপর ১৩ জুলাই এলএনজি আমদানিতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে বাংলাদেশ। এলএনজি আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি কমনওয়েলথ এলএনজির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) সই করেছে সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কোম্পানি। বছরে ১০ লাখ টন এলএনজি আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এ সমঝোতা সই হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close