দেশজুড়েপ্রধান শিরোনামশিল্প-বানিজ্য

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চমক আনতে পারে পর্যটন

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন একটা চমৎকার ভূমিকা রাখতে পারে। অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের আয়ের অন্যতম উৎস পর্যটন। কারণ পর্যটন কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে রাজস্ব বৃদ্ধি করে এবং দেশের মোট আয় ও উৎপাদনের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এমতবস্তায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটনখাত কত বড় পরিবর্তন আনতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। দীর্ঘ প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনা মহামারির কারণে দেশের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত খাত পর্যটন। করোনা মহামারি পৃথিবীর গতিপথকে এলোমেলো করে দেওয়ার আগের দশকে (২০০৮- ২০১৮) বিশ্বজুড়ে পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। উন্নত বিশ্বে অর্থনীতিকে টেনে ধরবার অন্যতম হাতিয়ার পর্যটন। ২০২৭ সাল নাগাদ বিশ্ব জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ১১ দশমিক ৭ শতাংশ হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বহাল রাখতে পর্যটন খাতকে গুরুত্ব দেওয়া একান্ত প্রয়োজন মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পৃথিবীতে বর্তমানে ১৪০ কোটিরও বেশি পর্যটক রয়েছে। এই সংখ্যা আসন্ন বছরগুলোতে অর্থাৎ ২০২৫ সাল নাগাদ, ২০০ কোটি হবে। এর আগে কোভিড মহামারির সময়ে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যায়। তবে ধীরে ধীরে এই সংখ্যা আবারও বাড়ছে।
গবেষণা বলছে, এই বিপুল পর্যটকের ৭৫ শতাংশ পর্যটক ভ্রমণের জন্য বেছে নেবে এশিয়া। আর সেখানেই বাংলাদেশের পর্যটন খাতকে নিজের সুযোগ তৈরি করে নিতে হবে। এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে এবারের বাজেট।

বাংলাদেশের পর্যটন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতে আছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। এর ভেতর সরাসরি জড়িত আছেন ১৫ লাখ আর প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে প্রায় ২৩ লাখ। এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করছে। এই সংখ্যাটি সন্তোষজনক হলেও এর মাত্র ২ শতাংশ বিদেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মোট ১৬ লাখ ৪০ হাজার পর্যটক আসে। এর মধ্যে ৮০ দশমিক ২৮ শতাংশ অনাবাসী বাংলাদেশি। বাকি ২ লাখ ৯১ হাজার জন বিদেশি পর্যটক। করোনা মহামারিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আরও কমেছে।
হতাশার বিষয় হলো, ইনক্লুসিভ ডেভলপমেন্ট ইনডেক্সের ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটনকে কাজে লাগিয়ে প্রবৃদ্ধির এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখানে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯ সাল জুড়ে আমাদের দেশে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ২৩ হাজার ২৯৫, যার অধিকাংশ ভারতীয়।

বর্তমানে দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলেও পর্যটকদের মনের ভয় এখনো দূর হয়নি। নিরাপত্তাজনিত ভয়ে পর্যটকদের অনেকেই আসছেন না। নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য সঠিকভাবে তুলে ধরাতেও গাফিলতি আছে বলে মনে করেন পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া আমাদের দেশের চিরায়ত চারু ও কারুশিল্প, মৃত্তিকাশিল্প, তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে এখনো জেলাভিত্তিক কোনো পর্যটন ব্যবস্থা দাঁড়ায়নি। এগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে। অভ্যন্তরীণ পর্যটনে সফলতা আসলে গ্রামীণ নারীরাও তাদের আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবে।

তবে আশার কথা হলো ইতোমধ্যেই পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করেছে সরকার। এসব প্রকল্পে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এইখাতে বিনিয়োগ করে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হওয়ার মাধ্যমে দেশের পর্যটনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।

ট্যুর অপারেটরস এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ এর প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক পরিচালক মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, ‘এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণাই হয়নি যে আমাদের দেশ এখন বিদেশি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। যতক্ষণ না আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা প্রজ্ঞাপন আসবে তারা এটা পরিষ্কারভাবে বুঝবে না যে আমরা এখন বিদেশিদের স্বাগত জানাচ্ছি। আরেকটি বিষয় হলো- বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা, এখনো পর্যটনকে শিল্প ঘোষণা না করায় আমরা প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত। অনেক ট্যুর অপারেটর আছে যাদের ৬০-৭০ জন কর্মী আছে। তবে শিল্প ঘোষণা না করায়, মহামারির পরেও আমরা কোনো প্রণোদনাই পাইনি।’

বিদেশি পর্যটকরা বাংলাদেশে আসতে আগ্রহী হচ্ছেন না কেন, এমন প্রশ্নে সময়নিউজকে তিনি জানান, বান্দরবানসহ পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটকদের ঢুকতে যে নিয়ম আছে তা ক্লান্তিকর। ডিসি অফিসে এপ্রুভাল নিতে হয়, টাকা দিতে হয়। যদি কোনো অ্যাপ থাকে যার মাধ্যমে এই এপ্রুভাল পাওয়া যেত তাহলে ভালো হত।

এছাড়া সুন্দরবন ঢোকার জন্য প্রতিবন্ধকতা ও নিয়মকানুনের বালাইয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেখুন আমরা সুন্দরবনকে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চাই অথচ একজন বিদেশি আসলে তাকে বাংলাদেশিদের তুলনায় ১০ হাজার টাকা বেশি দিতে হয়। এছাড়া কক্সবাজারে হোটেলগুলোতে রয়েছে দালালের দৌরাত্ম্য। আমরা যখন সেখানে যাই, অনেক সময় রুম পাই না।

দীর্ঘদিন পর্যটনের সঙ্গে জড়িত থাকা এই ব্যক্তি বলেন, বাংলাদেশ অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ। এখানে একজন রিক্সাচালক ইংরেজি না জানলেও বিদেশি কাউকে দেখলে হাত নেড়ে হেসে অভিভাদন জানায়। কিন্তু পর্যটনে এই বিষয়টা আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। বৈদেশিক মুদ্রা আনা-নেওয়াতেও ট্যুর অপারেটরদের কোনো নীতিমালা নেই বলেও অভিযোগ তার। তিনি বলেন, যখন ট্যুর অপারেটররা গেস্ট নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে তখন তাদের সঙ্গে টাকা নিয়ে যেতে হচ্ছে। এটা বড় একটি সমস্যা।

বাংলাদেশের বিখ্যাত পর্যটক এবং ‘পৃথিবীর পথে পথে’ বইয়ের লেখক তারেক অণুর সঙ্গে কথা বলে সময়নিউজ। তার কাছে প্রশ্ন ছিল পর্যটনে কোন বিষয়টি এখন বেশি দরকার। তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশ স্বল্প বাজেটে নিরাপদ ইয়ুথ হোস্টেল এর মত প্রচুর বাসস্থান তৈরি হওয়া দরকার, বিশেষ করে প্রতিটি জেলা সদরে। যেখানে সবাই নিজের মত প্রাইভেসি নিয়ে খুব কম খরচে প্রতিটি জেলায় ঘুরতে পারবেন। সেইসঙ্গে প্রত্যেকটি পর্যটনের সম্ভাবনা আছে তেমন জায়গায় এই ধরনের সস্তায় থাকা-খাওয়ার জায়গা ব্যবস্থা থাকতে পারে।

ইকো ট্যুরিজমের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে কটেজ নির্মাণ সাংঘর্ষিক কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে তারেক অণু বলেন, পর্যটনের জন্য যেখানে যত হোটেল বা যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে উঠুক সবার আগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে যাতে নতুন করে পরিবেশ নষ্ট করে কিছু না হয়। বাংলাদেশে পর্যটনের উন্নয়নে অনেক তরুণরাও এগিয়ে আসছেন।

তেমনি একজন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল শেষ করা সাদিফুজ্জামান দিগন্ত। তিনি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ‘ইকোফ্রেন্ডলি’ উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে বলেন, বর্তমানে পর্যটনের উন্নয়নে কাজ করছে বেশ কিছু তরুণ। এখন আমার ফুল টাইম প্রফেশন ট্যুরিজম। সুনামগঞ্জ টাঙ্গুয়া হাওরে ‘বজরা’ আমার নৌকা, এ মৌসুমে পরিবেশবান্ধব আরও বেশ কয়েকটা হাউজবোটের কাজ হচ্ছে। একটু তাকালে দেখবেন এখানে তৈরি করা হাউজবোট গুলো বেশির ভাগই কাঠের তৈরি, এখানে কোনো নৌকাতেই আপনি সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিকের ব্যবহার পাবেন না।
অনেক তরুণরা ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করতে এগিয়ে আসছে বলেও জানান তিনি। ‘আমি যেমন ব্র্যাক ভার্সিটি থেকে পাশ করে পর্যটন কাজ করছি, তেমন অনেক গ্র্যাজুয়েট ছেলে-মেয়ের ফুলটাইম প্রফেশন এখন পর্যটন। যারা কথার তুবড়ি ছোটায় শুধু উনাদের পৃষ্ঠপোষকতা না করে এইসব তরুণদের সরকার সহোযোগিতা করলে পর্যটনের উন্নয়ন হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া কমিউনিটি বেইসড ট্যুরিজম এর উন্নতিতে সরকারের সকল প্রশাসনের সহোযোগিতা প্রয়োজন বলেন তিনি।’

এদিকে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আমাদের পর্যটন শিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠার জন্য সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের পর্যটনে বিভিন্ন উপখাতের ব্যবসায় জড়িত পর্যটন অংশীজনদের সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন।

এছাড়াও, পর্যটন শিল্পের ক্ষতি চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের উপায় নির্ধারণের জন্য ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন, করোনাকালীন পর্যটন শিল্প পুনরায় চালুকরণের জন্য অনুসরণীয় নির্দেশিকা প্রস্তুত ও বিতরণ, অনুসরণীয় নির্দেশিকার উপর পর্যটন শিল্পের অংশীজনদের প্রশিক্ষণ প্রদান, ট্যুরিজম রিকোভারি প্ল্যান প্রস্তুতকরণ, পর্যটন শিল্পে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয়, পর্যটন শিল্পের বিভিন্ন অংশীজনদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান, জেলা ও উপজেলায় সচেতনতামূল কর্মসূচি গ্রহণ, অন-এরাইভাল ভিসার আওতা বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে পত্র প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা সীমাহীন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সরকার এ সুযোগ গ্রহণ করবে দেশের উন্নয়ন ত্বরাণ্বিত করার জন্য।
/একে

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close