দেশজুড়ে

মুক্তার চোখ দিয়ে পানি নয়, ঝরছে রক্ত

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ ১৫ বছরের সাদিয়া আক্তার মুক্তা। এ বয়সে আর দশটি মেয়ের মতো তারও জীবন কাটানোর কথা ছিল। কিন্তু সেই চঞ্চলতা নেই। মুক্তার চোখ দিয়ে পানি নয়, ঝরছে রক্ত। তার শারীরিক কষ্ট, জীবনের অনিশ্চয়তা আর দুঃখ ভর করেছে পুরো পরিবারে।

ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মুক্তা তেমন লেখাপড়া করতে পারেননি। নবম শ্রেণিতেই থমকে গেছে তার পড়াশোনা। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বহু কষ্টে কাটছে জীবন। প্রতিনিয়ত মুক্তার চোখ, নাক ও মুখ দিয়ে ঝরে রক্তধারা।

এমন অবস্থায় দিশেহারা ১৫ বছরের এ কিশোরীর দরিদ্র বাবা-মা। নিজের ও শ্বশুরবাড়ির জমি বিক্রি করে দুই বছরের বেশি সময় ধরে চিকিৎসা করিয়েছেন বাবা। কিন্তু কোনো ফল পাননি।

ভারতে নেয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। কিন্তু নিম্ন আয়ের পরিবারটির সেই আর্থিক সঙ্গতি নেই।

অবশ্য আরেকজন চিকিৎসক বলেছেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে। সেটাও পরিবারটির জন্য কঠিন এ কারণে যে, সব সঞ্চয় শেষ। আবার সম্পদ যা কিছু ছিল, সেগুলোও বিক্রি করে দিয়েছেন।

মুক্তার বাড়ি ঢাকার সাভার উপজেলার তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নে দক্ষিণ শ্যামপুর গ্রামে। তবে তাদের গ্রামের বাড়ি নাটোর সদর উপজেলার হয়বতপুরে।

ভাই-বোনের মধ্যে মুক্তা মেজো। তার একজন বড় বোন ও আট মাস বয়সী ছোট ভাই রয়েছে। মুক্তার মা গৃহিণী। আগে পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। সদ্য মা হওয়ার পর ছেড়ে দিয়েছেন চাকরিটাও।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী বাবা মাসুদ রানা। তিনি স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের পোশাক কারখানায় বয়লার অপারেটর। ১৬ হাজার টাকা বেতনে পরিবারের ভরণপোষণ ও মুক্তার চিকিৎসা ব্যয় চালাতে হয় তাকে।

প্রায় তিন বছর ধরে মুক্তার এমন দুর্গতি। তার বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার খবর শুনে স্ট্রোক করেন মুক্তা।

মাসুদ রানা বলেন, তিনদিনের ছুটিতে নাটোরে দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে ২০১৮ সালের ১১ আগস্ট আমি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হই। এতে আমার ডান পা ভেঙে যায়। সেই খবর মুক্তা সহ্য করতে পারেনি। ২৪ আগস্ট স্ট্রোক করে।

তখন মুক্তার বয়স ১৩ বছর। আমার আর মেয়ের অবস্থা দেখে স্ট্রোক করে মারা গেলেন আম্মা। আমার দাদিও মারা গেলেন। এরপর থেকে তার অসুস্থতা আরো বাড়তে থাকে। এক সময় মুখ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। এরপর নাক দিয়ে। এমন করতে করতে এখন দুই চোখ, মুখ, নাক দিয়ে রক্ত পড়ে অঝোরে।

মাসুদ বলেন, প্রথমে মুখ ও নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়। সেটি এক বছর আগের কথা। আর তিন-চার মাস ধরে চোখ দিয়ে রক্ত পড়ে।

মুক্তার বাবা বলেন, রক্ত পড়ার সময় চোখ জ্বালাপোড়া করে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে পাতলা রক্ত আসত। ধীরে ধীরে শুরু হয় ঘন রক্ত আসা।

চোখের পানি যেভাবে পড়ে ওইভাবে দুই চোখ বেয়ে রক্ত পড়ে। কখনো ১০ মিনিট রক্ত পড়ে। আবার কখনো এক ঘণ্টা ধীরে ধীরে পানির মতো পড়তে থাকে। কখনো দুই-চার মিনিট পড়ার পরই বন্ধ হয়ে যায়, স্বাভাবিক হয়ে যায়।

মেয়ের এমন দুর্গতির কথা বলতে বলতে চোখে পানি চলে আসে বাবা মাসুদ রানার। তিনি বলেন, বমি যতক্ষণ বন্ধ না হয় ততক্ষণ রক্ত পড়তেই থাকে। বমির প্রেশার বেশি হলেই রক্ত বেশি পড়ে। নাক, মুখ, চোখ দিয়ে রক্ত পড়ার আগে বমি আসে। মাথা ব্যথা করে, চোখমুখ জ্বালাপোড়া করে। দিনে তিন-চারবার রক্ত আসে। দিনে না হলে রাতে রক্ত পড়েই। যা খায় তার চেয়ে বেশি রক্তবমি করে।

মেয়ের চিকিৎসার জন্য সাধ্য অনুযায়ী সব জায়গায় গেছেন মাসুদ রানা। ঢাকার নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট, সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও চিকিৎসা করিয়েছেন।

মেয়েকে সবশেষ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক মাস রেখেছেন মাসুদ রানা। বলেন, চিকিৎসকরা ভারতের ভেলরে নিয়ে যেতে বলেছেন।

নিজের আর্থিক অসঙ্গতির কথা তুলে ধরে মুক্তার বাবা বলেন, পুরোপুরি চিকিৎসা করানোর মতো আমার সামর্থ্য নাই। বাংলাদেশেও যে আমি একটু ভালো চিকিৎসা করাব, সেই সামর্থ্যও নাই। নরমাল চিকিৎসাও এখন করাতে পারি না। আমার সামান্য ১৬ হাজার ৭০০ টাকা বেতন। এছাড়া চিকিৎসা করাতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা ঋণ হয়ে গেছে।

আমার যা ছিল, এখন মনে করেন নিঃস্ব পর্যায়ে চলে আসছি। মুক্তার, আমার, তার দাদির একই সময়ে সব চিকিৎসা করাতে হয়েছে। আমার জন্য শ্বশুরবাড়ির জমিও বন্দক দিয়েছে। এখন নূন্যতম লাখ দুয়েক টাকা হলে মুক্তাকে ভারতে নিয়ে যেতে পারব। মেয়ে সুস্থ হোক এতটুকু পেলেই আমার জন্য যথেষ্ট।

বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিপ্রোডাক্টিভ অ্যান্ড চাইল্ড হেলথের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণরত চিকিৎসক আমজাদুল হক বলেন, সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। রোগীর প্রেসক্রিপশন ও ছবি দেখে বুঝলাম এখানে আসলে একটা রোগ না একাধিক রোগ আছে এবং ব্লাড জিস-অর্ডার আছে।

সঙ্গে সাইকোলজিক্যাল এবং নিউরোলজিক্যাল সমস্যা আছে। হরমোনের কোনো সমস্যা এবং টিবি রোগ আছে কি না, সেটি জানতে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।

/এন এইচ

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close