প্রধান শিরোনামবিশেষ প্রতিবেদন

শীতের জন্য নয়, খাবারের খোঁজে আসে অতিথি পাখি

আব্দুল্লাহ আল ওয়াহিদ: সুবজ গাছের ফাঁকে লাল ইটের দৃষ্টিনন্দন দালান। লেক গুলোতে রক্ত কমল শাপলা আর পদ্ম ফুলের মাঝে শীতে পরিযায়ী এবং দেশীয় পাখিদের ডুবসাঁতার আর খুনসুটি। বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে আবৃত জঙ্গলে খেকশিয়াল আর কাঠবিড়ালিদের আনাগোনা, এ যেন সরল প্রকৃতি অন্যরকম এক পরিবেশ।

বলছি সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। এখানে শীত মানেই উৎসব, সে উৎসব প্রকৃতির, সে উৎসব পাখির, সে উৎসব প্রজাপতির, সে উৎসব ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীসহ প্রকৃতি প্রেমীদের। সৌন্দর্যের নগরী, নৈসর্গের বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা নিপুন কোন ছবি।

সেই গল্প হয়তো শেষ হবে না। তবে তারমধ্যে থেকে জানাবো বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি পাখির সাতকাহন।

উত্তরের শীত প্রধান দেশ গুলো থেকে আসা পরিযায়ীদের এক নিরাপদ স্বজনবাড়ি এই বিশ্ববিদ্যালয়। বহুকাল ধরেই বিদেশী পাখিরা বাংলাদেশে আসে বিভিন্ন হাওর, বাওর, ঝিল এবং লেকে সেই সাথে আসে এই সুবজ ক্যাম্পাসে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান সূত্রে জানা যায় ১৯৮৬ সাল থেকে এ ক্যাম্পাসে আসতে শুরু করে পরিযায়ী পাখিরা। মোট ২০৪ প্রজাতির পাখি সনাক্ত করা হয়েছে এর মধ্যে ১২৬ প্রজাতি স্থানীয় আর বাকিরা পরিযায়ী। শীত মৌসুমের শুরু থেকেই সুদূর সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া সহ হিমালয়ের উত্তর গোলার্ধের দেশ গুলো থেকে পরিযায়ীরা খাবারের খোঁজে আসে বাংলাদেশ। তার মাঝে প্রিয় আবাসস্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়গুলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়ে যে সকল পাখি দেখা যায় তাদের মধ্যে প্রথমেই সবার নজরে পড়ে সরালি, পচার্ড, ফ্লাইফেচার, গার্গেনি, খঞ্জনা, জলপিপি, লাল ঠোঁট, শামুক ভাঙ্গা সহ দেশীয় নানান প্রজাতির পাখি।

কাদাখোঁচা দের জীবনযাত্রায় লক্ষ্য করলে দেখা যায় এরা প্রচন্ড শীত থেকে রক্ষা পেতে আর খাবারের খোঁজে জাপান ছেড়ে পূর্ব অস্ট্রেলিয়া এবং তাসমিনা পর্যন্ত আশ্রয় নেয়।

সেক্ষেত্রে এদের সমুদ্র পাড়ি দিতে হয় পাঁচ হাজার কিলোমিটারের ও বেশি পথ। তাও এই পথ পাড়ি দিতে ওরা কোনরকম বিরতি নেয় না।

বিষয়টা আশ্চর্য বটে। সমুদ্রে বিরতি নেওয়ার সুযোগ থাকেনা, কেননা কাদাখোঁচা পাখিরা জলচর হলেও সমুদ্র কিংবা নদীর জলে ভাসার অভ্যাস নেই এদের, এরা জলার ধারে বিচরণ করে জলাশয়ে নয়।

এই পরিযায়ীদের কে আমরা আদর করে ডাকি অতিথি পাখি। মূলত আমরা অনেকেই এই পাখিদেরকে অতিথি পাখি বলেই ডাকি কিন্তু এরা পরিযায়ী পাখি, পরিযায়ী বলার কারণ হচ্ছে এই পাখিগুলো খাবারের খোঁজে এবং বংশ বিস্তারের জন্য বিভিন্ন দেশে পরিযায়ন করে থাকে যে কারণে এদেরকে পরিযায়ী পাখি বলা হয়।

পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যেই আছে আরেকটি ভুল ধারণা, অনেকেই মনে করে এই পাখিগুলো উত্তরের শীত প্রধান দেশগুলোর শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য উত্তরাঞ্চল ছেড়ে দক্ষিণাঞ্চলে পাড়ি জমায়, কারণটা মোটামুটি ঠিক হলেও এর সঠিক কারণ হচ্ছে এরা আসে খাবারের খোঁজে, কেননা পরিযায়ী পাখিদের গায়ে রয়েছে রেশমি পশম তা দ্বারা তারা কঠিন শীত নিবারণ করতে পারে, এছাড়াও পাখিদের শরীরে রয়েছে গরম রক্ত যে কারণে নিমিষেই অত্যন্ত শীতের প্রকোপ থেকে নিজেদের রক্ষা পাওয়াতে তারা সক্ষম।

মূলত এই সময়ে উত্তরের শীতপ্রধান দেশগুলোতে এখন শীতের প্রকোপ এতটাই বেশি সেখানকার জলাশয় এবং ঘাস লতাপাতায় বরফ জমে যায়, ফলে সে দেশগুলোতে এখন পাখিদের তীব্র খাবার সংকট তৈরি হয়, তাই খাবারের খোঁজে তারা বের হয় নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলোকে লক্ষ্য করে।

এ নিয়ে কথা হয় ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কোলাহল জনিত পরিবেশকে পাখির অভয়ারণ্য নষ্ট হওয়ার কারণ মনে করছেন দর্শনার্থীরাও। তবে জাবি ক্যাম্পাসের এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ তারা।

আব্দুর রহমান নামে দর্শণার্থী বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিযায়ী পাখিরা যেমন নিরাপদ, বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় যদি তারা এমন নিরাপদ হত তাহলে বিশ্বে পরিযায়ীদের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বাংলাদেশ খেতাব পেতো। তবে ক্যাম্পাসে আসা দর্শনার্থীরা প্রশাসনের দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী যদি পাখিদের সৌন্দর্য উপভোগ করে তাহলে পরিবেশ নষ্ট হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সুমাইয়া আজাদ রোজ নামে দর্শণার্থী বলেন, দেশের বিভিন্ন হাওর, বাওর ও ঝিল গুলোতে পরিযায়ী পাখিদের যেমনি প্রজাতির সংখ্যা কমেছে তেমনি পাখিদের সংখ্যাও কমেছে। আর তা ঠেকাতে  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিযায়ীদের জন্য যেমন নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করেছেন, তেমনি বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত এখন সারাদেশে পরিযায়ীদের জন্য এমন আরো কিছু নিরাপদ অভায়ারণ্য তৈরীর পদক্ষেপ নেওয়া।

ক্যাম্পাসের অতিথি পাখিদের নিয়ে কথা হয় পাখি গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ কামরুল হাসানের সাথে, তিনি বলেন এবছর এখন পর্যন্ত তিন প্রজাতির হাঁস জাতীয় পাখি দেখা গিয়েছে তা হচ্ছে ছোট সরালি, বড় সরালি এবং লেঞ্জা হাঁস।

তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আসা দর্শনার্থীরা যেন অতিথি পাখিদের বিরক্ত না করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পিকনিক স্পটেরূপ নিয়েছে, আগত দর্শনার্থীরা পাখিদের বিরক্ত সহ পরিবেশ নষ্ট করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আগত দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক গুলোর নিরাপদ বেষ্টনীর বাইরে থেকে পরিবেশ শান্ত রেখে পাখিদের সৌন্দর্য উপভোগ করার আহ্বান জানান দর্শনার্থীদের।

ছবি: আব্দুল্লাহ আল ওয়াহিদ

 

 

 

 

 

লেখক: সাংবাদিক, মাই টিভি

ছবি তুলেছেন: আসাদুজ্জামান নূর

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close