জীবন-যাপনস্বাস্থ্য

সুপার হিরো আপনার শরীরে

 ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: কী ভাবছেন? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী আপনি, অথচ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক ভাইরাসকে পরাস্ত করতে পারছেন না! ভয়ে গুটিয়ে ঘরে বসে আছেন। ভুল। প্রতি সেকেন্ডে আপনি পরাস্ত করে চলেছেন এক নয়, অসংখ্য জীবাণুকে। আছে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস। প্রতিদিন প্রায় ১০ কোটি ভাইরাস আপনার শরীরে ঢুকছে। অবশ্য এর অধিকাংশই ক্ষতিকর নয়। তবে সংক্রমণ করে ক্ষতি করতে পারে, এর সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

ভাইরাস অতি চালাক। শরীরে ঢুকে আমাদের কোষের ভেতরে অতি সূক্ষ্ম যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। উদ্দেশ্য একটাই—নিজের বংশবৃদ্ধি। এক-আধটা নয়, কোটি কোটি। ভাইরাস হলো বড় ধরনের কাপুরুষ। নিজের থেকে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে না। নিজে খেতে পারে না। একাকী একদম অসহায়-অক্ষম। আর সে জন্যই আমাদের কোষের ভেতরে প্রবেশ করে পুষ্টি আর শক্তি সঞ্চয় করে। কিছুক্ষণের জন্য আমাদের কোষকে বোকা বানায়। মানব শরীরে আক্রান্ত একটি কোষ থেকে ১০ হাজার ভাইরাস জন্ম নেয়। আক্রমণ করে আরেক মানবকোষকে। ভাইরাসজনিত সংক্রমণ ইনফ্লুয়েঞ্জার কথাই ধরুন। সংক্রমণ হলে আপনার রক্তের প্রতি মিলিলিটারে (এক লিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগ) ১০ লাখ বা তারও বেশ কয়েক গুণ ভাইরাস থাকে। ঘাবড়ে যাবেন না।

আপনার শরীরে পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী গোয়েন্দা আছে। পাহারাদার। অসম্ভব বুদ্ধিমান। অ্যান্টিবডির কথা বলছি। আপনার শরীরে ৩০ কোটি বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবডি রয়েছে। সংখ্যাটা এত বেশি কেন? এদের আকার ভিন্ন। অর্থাৎ একটির সঙ্গে আরেকটির আকার মিলবে না। আগেই বলেছি, ভাইরাস অতি চালাক। বহুরূপী। আপনার শরীরের অ্যান্টিবডি ওই ভাইরাসের থেকেও অনেক বুদ্ধিমান। ভাইরাসের সম্ভাব্য সব রকম আকার-আকৃতি আর ব্যবহার তার নখদর্পণে। ভাইরাস যে আকার–আকৃতি ধারণ করুক না কেন, তার সঙ্গে সখ্য পাতাতে আপনার শরীরের অ্যান্টিবডির জুড়ি নেই। সে জন্যই ৩০ কোটি আকার-আকৃতি। ভাইরাস সংখ্যা বৃদ্ধি করে অতি দ্রুত।

আপনার অ্যান্টিবডি কি বসে থাকবে? একদমই নয়। প্রতি সেকেন্ডে দুই হাজার নতুন অনুরূপ তৈরি করছে একটা অ্যান্টিবডি। এরপর শুরু হয় মহাযুদ্ধ। ভাইরাসের বিরুদ্ধে। ভাইরাস থেকে চালাক না হলে পরাস্ত করা যাবে না। অ্যান্টিবডি যখন ভাইরাসকে চিনে ফেলে, আকারে-আকৃতিতে, যুদ্ধটা আসলে তখনই শুরু হয়। নেতৃত্বে থাকে বি-কোষ। দলে দলে অ্যান্টিবডি পাঠানো শুরু হয়। অ্যান্টিবডি গিয়ে ভাইরাসের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। ভাইরাসের আকার–আকৃতি জানা থাকায় সখ্য করতে অসুবিধা নেই। অ্যান্টিবডিগুলো ভাইরাসের থেকে আকারে অনেক ছোট। সখ্য গড়ে তোলা মানে হলো ভাইরাসের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে সেঁটে থাকা। উদ্দেশ্য একটাই। ভাইরাসকে বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করা। যাতে মহাশক্তিশালী শ্বেত রক্তকণিকা চিহ্নিত ভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে। একটা ভাইরাসকে চিহ্নিত করার জন্য মাত্র দুটি অ্যান্টিবডি যথেষ্ট। একবার ভাইরাসকে চিনতে পারলে আপনার শরীর ভবিষ্যতে একই ভাইরাসের সব আক্রমণ রুখতে পারবে।

প্রশ্ন হচ্ছে—করোনাভাইরাস আক্রমণ করলে মোকাবিলা করতে পারছে না কেন? উত্তর হলো পারছে। গতকাল শনিবার পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৭৫ লাখের বেশি। আর মৃত্যুর সংখ্যা ৪ লাখ ২৩ হাজার। শনাক্ত হয়নি কিন্তু আক্রান্ত হয়েছেন, এ সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাহলে কী বলবেন? আপনার শরীর হেরে যাচ্ছে?

ভাইরাসের পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়াও তো কম নয়। শরীরের ভেতরে এবং বাইরে সব জায়গায় তার অবস্থান। সংখ্যার বিচারে কোটি কোটি। পাচকতন্ত্র এবং শ্বাসযন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে। শর্করাকে ভাঙে ব্যাকটেরিয়া, অন্ত্রের সংক্রমণ রোধ করে। খারাপ ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে প্রবেশের জন্য প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করছে। অন্ত্রের বিশেষ ধরনের কোষ ম্যাক্রোফেজ ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে মোকাবিলা করছে প্রতিনিয়ত। ম্যাক্রোফেজ ব্যাকটেরিয়াকে নিজের শরীরে গিলে ফেলে। এরপর এনজাইমের মাধ্যমে এগুলোকে ধ্বংস করে। অবস্থা খারাপ হলে রক্তনালিকে বলে আক্রমণের স্থানে পানি সরবরাহ করতে। ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধটা যাতে সহজ হয়। শরীরে কোথাও কেটে গেলে ফুলে যাওয়ার কারণ হলো এটা। যুদ্ধটা কঠিন হলে কোষ বিশেষ প্রশিক্ষিত সৈন্য পাঠাতে সংকেত দেয়। সঙ্গে জানিয়ে দেয়—কোথায় আসতে হবে, কতটা দ্রুত আসতে হবে। নিউট্রোফিল হলো সেই বিশেষ প্রশিক্ষিত সৈন্য। রক্তনালির ভেতরে টহলে থাকে। সার্বক্ষণিক। সংকেত পেলেই ছুটে গিয়ে ব্যাকটেরিয়াকে বেঁধে ফেলে। সেই সঙ্গে শরীরের সুস্থ কোষকেও মেরে ফেলে। নিউট্রোফিল হলো আত্মঘাতী সৈন্য। পাঁচ দিন পর নিজে আত্মঘাতী হয়, সুস্থ কোষের অতিরিক্ত মৃত্যু ঠেকাতে। এতে কাজ না হলে মহাশক্তিধর টি-সেলকে মাঠে নামানো হয়।

ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়াকে ঘায়েল করার জন্য শরীরের সব থেকে ছোট সদস্যরা গড়ে তোলে অবিশ্বাস্য প্রতিরোধব্যবস্থা। শত্রুকে শনাক্ত করা, অবস্থান নির্ণয়, আক্রমণের মাত্রা ঠিক করা সবকিছুই হয়ে থাকে অত্যন্ত দ্রুততায়। অসাধারণ সমন্বয়, নিরবচ্ছিন্ন তথ্যের আদান-প্রদান, আক্রমণের তীব্রতা আর অতি অবিচল আনুগত্য। এ রকম হাজার কোটি কোষ শরীরে আমৃত্যু নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে। এর থেকে শক্তিশালী ক্ষুদ্র যন্ত্র এই পৃথিবীতে আর নেই।

এবার একটু বড় অঙ্গের কথা বলি। আপনারা হার্ট বা হৃদ্‌যন্ত্র পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আর নির্ভরযোগ্য পাম্প। প্রতিদিন আপনার হৃৎস্পন্দনের সংখ্যা ১ লাখ ১৫ হাজার। সারা জীবনে ২৫০ কোটিবার। প্রতি মিনিটে সাড়ে পাঁচ লিটার রক্ত সরবরাহ করছে আপনার শরীরে। দিনে ৯ হাজার লিটার, বছরে ৩০ লাখ লিটার। বছরের পর বছর আপনার শরীরের ৬০ হাজার মাইল দৈর্ঘ্যের রক্তনালিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করছে। মাত্র পাঁচ ইঞ্চি লম্বা আর ২৩০ থেকে ২৮০ গ্রাম ওজনের একটা ছোট্ট যন্ত্র। কোনো ক্লান্তি নেই, কাজে অবহেলা নেই, থামার তো কথাই ওঠে না। দাবি সামান্যই। একটু হাঁটাচলা করুন, স্বাস্থ্যকর খাবার খান আর মন খুলে হাসুন। গবেষণা বলছে, মন খুলে হাসলে হার্টের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

শরীরে রয়েছে অসংখ্য অবিশ্বাস্য সব যন্ত্র। সুপারহিরো। আপনার চোখ প্রায় ২০ লাখ যন্ত্র দিয়ে তৈরি। ৭০ লাখ ভিন্ন ধরনের রং শনাক্ত করতে পারে। চোখের চেয়েও জটিল হলো আমাদের মস্তিষ্ক। এর ওজন শরীরের মোট ওজনের মাত্র ২ শতাংশ। দেড় কিলোগ্রামের থেকে কিছু কম। ১০০ বিলিয়ন নিউরন দিয়ে তৈরি। মস্তিষ্কে নিউরনের সংখ্যা মহাবিশ্বের তারার সংখ্যার প্রায় সমান। নিউরন হলো এক ধরনের বিশেষ কোষ। কম্পিউটারের থেকেও দ্রুতগতিতে সমস্যার সমাধান করতে পারে। মস্তিষ্ক সচল রাখতে দরকার মাত্র ২০ ওয়াটের শক্তি। একই ক্ষমতার কম্পিউটার চালাতে এর চেয়ে অনেক বেশি শক্তি প্রয়োজন হয়। এক সেকেন্ডের ১০ হাজারের এক ভাগ সময় লাগে মস্তিষ্কের সাড়া দিতে। ধরুন, আপনাকে দুই হাজার ছবি প্রতিটি মাত্র তিন সেকেন্ড করে দেখতে দেওয়া হলো। আপনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুনরায় দেখলেই বলতে পারবেন আগে দেখেছেন কি না। মস্তিষ্কের তথ্য জমা রাখার ক্ষমতা হলো ২ হাজার ৫০০ টেরাবাইট। অধিকাংশ কম্পিউটারের মেমোরি ৩০ টেরাবাইট।

একবার ভাবুন, পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক শক্তিশালী একাধিক যন্ত্রের সমন্বয়ে তৈরি আপনার শরীর। শেষ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেতে চায়। তাই শরীরটার একটু যত্ন নিন। ভালো থাকুন, ভালো ভাবুন।

সুব্রত বোস: প্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস অ্যানালিটিকসের গ্লোবাল প্রধান।

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close