দেশজুড়ে

অকাল বন্যার জন্য দায়ী কে? ফারাক্কা বাধের প্রভাব কি?

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ বহু পুরানো। সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত ফারাক্কা ব্যারাজকে ঘিরে। শুকনা মৌসুমে এই ব্যারাজ দিয়ে পানি আটকে দেয় ভারত। বর্ষা মৌসুমে ব্যারাজের সব ফটক খুলে পানি ছেড়ে দেয় বাংলাদেশের দিকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু মানুষ লিখছেন, এবার যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, তার জন্যও ভারতই দায়ী।

বাংলাদেশের পানি মন্ত্রণালয় বলছেন এ জন্য দায়ী অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত। কেউ কেউ আবার এমনও বলছেন, বৃষ্টির পানি ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে আটকে ভারত কেন নিজের ক্ষতি করবে?

সাদা চোখে দেখলে দুটো বক্তব্যই সত্যি। শুকনা মৌসুমে ফারাক্কা ব্যারাজের মাধ্যমে যেভাবে পানি আটকে রাখা হয়, তা বর্ষা মৌসুমেও করা হলে বাংলাদেশে এতটা বন্যা হতো না। কিন্তু গঙ্গা চুক্তিতে এমন বিধান তো আসলে নেই। চুক্তিতে শুকনা মৌসুমের অল্প পানি ‘ন্যায়সংগতভাবে’ ভাগাভাগি করার ব্যবস্থা বাংলাদেশ-ভারত করেছে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে বেশি পানির বোঝা দুই দেশ ন্যায়সংগতভাবে বহন করবে এমন কোনো বিধান নেই গঙ্গা চুক্তিতে।

সমস্যাটা রয়েছে বাংলাদেশ–ভারতের চুক্তিগুলোতে। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যতোগুলো চুক্তি হয়েছে, তাতে দুই দেশের মধ্যে বছরে মাত্র পাঁচ মাসের (জানুয়ারি থেকে মে মাস) পানি ভাগভাগির কথা বলা হয়েছে। ভরা মৌসুমের পানি অতিকায় প্রকল্পের মাধ্যমে ধরে রেখে বন্যার প্রকোপ কমানো এবং তা শুকনা মৌসুমে ব্যবহার করার চিন্তাও এসব চুক্তিতে ছিল। কিন্তু প্রকল্পটির ধরন কী হবে, কোথায় এটি হবে এবং এতে নেপালকে সংযুক্ত করা হবে কি না, এসব বিরোধে এটি আর বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে ভরা মৌসুমে ফারাক্কা পয়েন্ট দিয়ে অবাধে আসা বন্যার তোড় অনেক বেশি বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

ছবিঃ ফারাক্কা বাঁধ ।

এটি ঠিক যে ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মিত না হলেও ভরা মৌসুমের এই পানি বাংলাদেশেই আসত। কিন্তু এটি তখন হতো প্রাকৃতিকভাবে। বহু বছর ধরে শুকনা মৌসুমে গঙ্গা থেকে কম বা খুবই কম পানি পেয়ে বাংলাদেশের নদীকেন্দ্রিক ভূপ্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতিটা ফারাক্কা ব্যারাজ না থাকলে হতো না। বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে পদ্মা ও এর শাখা নদীগুলোর গতিপথ, স্রোত ও গভীরতা তখন প্রাকৃতিকভাবেই নির্ধারিত হতো। প্রকৃতিকে নিজের মতো চলতে দিলে বন্যায় ক্ষতির চেয়ে লাভই হয়তো বেশি হতো বাংলাদেশের।

ভারত–বাংলাদেশ গঙ্গা চুক্তিগুলোর আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে চুক্তির ধারাগুলো অববাহিকাভিত্তিক নয়। বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে নদীকে যৌথ সম্পদের মতো বিবেচনা করে অববাহিকার সব রাষ্ট্র মিলে সমন্বিতভাবে এর উন্নয়ন, ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা করে থাকে। লক্ষ্য থাকে যেকোনো দেশকে বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা করা, নদীর পানির টেকসই ব্যবহার করা এবং নদীটির ও এর প্রতিবেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা।

ভারত–বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে এর বহু কিছুই করা হয়নি। এতে নেপালকে রাখা হয়নি, এমনকি উত্তর প্রদেশ ও বিহারে গঙ্গার পানি ব্যবহারকে সমন্বিত করা হয়নি। এসব রাজ্য ও পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার পানি একতরফা ব্যবহারের পর লেজের অংশে থাকা অবশিষ্ট পানি ভাগাভাগি করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই পানি বাংলাদেশের চাহিদার তুলনায় নিদারুণভাবে কম।

বাংলাদেশে অকাল প্লাবন ।

শুষ্ক মৌসুমে কম পানি পাওয়ার কারণে জি-কে প্রকল্পসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সেচকার্যে সমস্যা হচ্ছে, প্রাণী বৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং নিম্ন অববাহিকায় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি আরও ভেতরে ঢুকে নানা বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। কয়েক দশক যাবৎ বাংলাদেশ চিন্তা করছে এই ক্ষতি এড়াতে নিজেরাই একটি গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করবে কি না। এর ফিজিবিলিটি স্টাডিও সম্পন্ন হয়েছে বছর পাঁচেক আগে। অথচ মাত্র গত মাসে ভারতের সচিব এসে বলেছেন, এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আগে দেখতে হবে। এক. প্রকল্পে ভারতের কোনো ক্ষতি যাতে না হয়। দুই. প্রকল্পে কোনো লাভ হলে তার অংশীদারও ভারতকে করা যায় কি না।

এসব বিষয়ে রাজি হয়ে বাংলাদেশও সবকিছু খতিয়ে দেখার জন্য নতুন একটি যৌথ স্টাডি কমিটি করতে সম্মত হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে মনে হবে এতে সমস্যা কী? কিন্তু গভীরভাবে বিষযটি দেখলে প্রশ্ন আসে: ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ বা চালু করার আগে এমন ষ্টাডি কি ভারত করেছিল? এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ও পরে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘে নালিশ করার পরও ভারত কি তার সিদ্ধান্তগুলো থেকে একটুও থেমে ছিল? যাঁরা এসব বিষয় জানেন, তাঁরা জানেন কীভাবে নানা অজুহাতে তিস্তাসহ বড় ধরনের আটটি অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি গত ৩৪ বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে ভারত। এই ইতিহাস যাঁদের মনে থাকে, তাঁদের মনে প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক।

একইভাবে বন্যার জন্য ভারত দায়ী শুনলে অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে। কিন্তু অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে এমন অতিশয়োশক্তি করার মনোভাব দেশের সাধারণ মানুষের থাকতেই পারে। কারণ, নদীর পানি বাড়লে–কমলে প্রভাবিত হয় তার জীবন। এর আঁচ দেশের শাসকদের গায়ে লাগে না। সম্ভবত অন্তরেও লাগে না আর।

ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ ভবিষ্যতে আরও অভিযোগ করবে। তার মধ্যে কখনো কখনো হয়তো অতিরঞ্জন থাকবে। কিন্তু এটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে সরকারের অতিরঞ্জনের স্বাভাবিক প্রতি-বয়ান। এর জন্য মানুষ দায়ী না, দায়ী ভারত-বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা।

/আরএইচ

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close