দেশজুড়েপ্রধান শিরোনামশিল্প-বানিজ্য

শতভাগ উৎপাদনমুখিতা থেকে সরে আসছে লবণ শিল্প

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: ৬১ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশে রেকর্ড লবণ উৎপাদন হয়েছে সর্বশেষ মৌসুমে। বিগত সময়গুলোয় উৎপাদন কম থাকলেও চাহিদার সঙ্গে সংগতি থাকায় তেমন একটা আমদানি করতে হয়নি। তবে এ বছর রেকর্ড উৎপাদনের পরও সম্ভাব্য চাহিদার ঘাটতি থাকায় পাঁচ লাখ টন আমদানি করতে হবে। উৎপাদন এলাকার জমিতে সরকারি একাধিক মেগা প্রকল্পের কারণেও চাষের পরিধি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ভোজ্য-বহির্ভূত শিল্প-কারখানায় চাহিদা দ্রুত বাড়তে থাকায় শতভাগ উৎপাদনমুখী খাত থেকে সরে আসছে লবণ শিল্প।

চলতি বছর দেশে লবণের চাহিদা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৩৫ হাজার টন। ২১ মে পর্যন্ত সর্বমোট উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার টন। ঘাটতি থাকছে ৫ লাখ ৩ হাজার টন। ঘাটতি পূরণে এরই মধ্যে দেড় লাখ টন লবণ আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। গত জানুয়ারিতে এসব লবণ আমদানির অনুমোদন দেয়া হলেও দেশীয় উৎপাদন বাড়তে থাকায় আমদানির আইপি (ইমপোর্ট পারমিশন) স্থগিত করা ছিল। সরকারের লবণ নীতির খসড়া অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে শিল্প খাতের লবণের চাহিদা ৭৫ শতাংশ বাড়বে। ফলে বর্তমান জমি ও সনাতনী পদ্ধতি দিয়ে চাহিদার শতভাগ লবণ উৎপাদন সম্ভব হবে না। এতে চলতি বছরের মতো আগামী বছরগুলোতেও লবণ আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ মৌসুমে দেশে লবণের চাহিদা ছিল ১৮ লাখ ৪৯ হাজার টন। উৎপাদন হয়েছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার টন। ২০২০-২১ মৌসুমে চাহিদা ছিল ২২ লাখ ৫৬ হাজার টন। কিন্তু চাহিদা পূরণ না হলেও উৎপাদন তার আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়ে হয় ১৬ লাখ ৫১ হাজার টন। তবে পূর্ববর্তী বছরের কিছু মজুদ থাকায় গত বছর দেশে লবণ আমদানির প্রয়োজন হয়নি।

জানতে চাইলে বিসিকের লবণ মাঠ পরিদর্শক (কক্সবাজার) মো. ইদ্রিস আলী বণিক বার্তাকে বলেন, লবণ চাষের জমি কমছে। পাশাপাশি চাহিদাও বাড়ছে। গত কয়েক বছরে চাহিদার প্রায় সমপরিমাণ লবণ উৎপাদন হলেও এখন বাড়তি লবণ আমদানি ছাড়া চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। বিকল্প জমি পাওয়া না গেলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যমান চাষাধীন জমিতেই বাড়তি লবণ উৎপাদন করতে পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে উপর্যুপরি চাহিদা বাড়তে থাকলেও দেশে লবণ চাষাধীন জমির পরিমাণও কমছে। বিসিকের তথ্য বলছে, দেশে লবণ চাষাধীন জমির পরিমাণ প্রায় ৭৩ হাজার একর। ২০০৪-০৫ সালের সরকারি-বেসরকারি পাঁচটি সংস্থার যৌথ জরিপে লবণ চাষের জমি ও কৃষক পরিবারের সংখ্যা উঠে আসে। ওই সময় প্রায় ৪০ হাজার কৃষক লবণ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত আছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে কক্সবাজার মাতারবাড়ী, টেকনাফ অঞ্চলে সরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমে লবণ মাঠ কিছুটা কমে ৬৫ হাজারে নেমে আসে। মূলত মহেশখালীতে প্রায় ছয় হাজার একর জমি সরকারি একাধিক মেগা প্রকল্পের জন্য চলে যাওয়া এবং সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার ভাঙন ও ঘরবাড়ি তৈরির কারণে জমির পরিমাণ ক্রমেই কমছে। এ কারণে নতুন লবণ চাষের জমি ছাড়াও লবণ চাষ পদ্ধতির আধুনিকায়ন জরুরি বলে মনে করছে বিসিক।

জানা গেছে, কক্সবাজারের সাতটি ও চট্টগ্রামের একটি উপজেলায় উৎপাদিত লবণ দেশের মোট চাহিদা মেটায়। কক্সবাজারে আটটি উপজেলার মধ্যে উখিয়া ছাড়া সাতটি উপজেলাই লবণ চাষের উপযোগী। এছাড়া চট্টগ্রামের একমাত্র বাঁশখালী উপজেলার সমুদ্র তীরবর্তী জমিতে লবণ চাষ হয়। কক্সবাজারের লবণ চাষাধীন জমিগুলোর মধ্যে মহেশখালীতে রয়েছে ২০ হাজার একর। সাম্প্রতিক সময়ে মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ একাধিক ভারী শিল্প-কারখানা স্থাপনের কাজ চলমান থাকায় লবণ চাষের জমির পরিমাণ কমে আসছে। কয়েক বছরের মধ্যে এ উপজেলায় লবণ চাষের জমি কমেছে তিন হাজার একর। এছাড়া কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় আরো প্রায় তিন হাজার একর জমি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করেছে সরকার। যার কারণে লবণ চাষের বিকল্প উৎস জমি খুঁজছে বিসিক।

এ লক্ষ্যে ২০১৯ সালের শুরুতে চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে পরিবেশবান্ধব লবণ শিল্পপার্ক স্থাপনে ২৫ হাজার একর জমি চেয়ে চিঠি দেয় বিসিক। এর পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে চিঠিও দেয় বিসিক কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিসিকের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা সরেজমিন সন্দ্বীপ শিল্পপার্কের জমির বিষয়ে তদারকিও করেন। তবে অপ্রতুল জমি ও জেগে ওঠা চর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) দেয়ার সরকারি পরিকল্পনা থাকায় বিসিকের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন। ফলে বাংলাদেশে লবণ চাষের বিকল্প কোনো জমি খুঁজে পাচ্ছে না বিসিক কর্তৃপক্ষ।

জানা গিয়েছে, লবণ উৎপাদনের সনাতনী পদ্ধতি থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে রূপান্তর সময়সাপেক্ষ। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর কয়েক বছর আগেই বিসিক পাইলটিং প্রকল্পের অধীনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। সনাতনী পদ্ধতিতে একরপ্রতি ৭৫০ মণ থেকে ৭৭৫ মণ লবণ উৎপাদন হলেও নতুন পদ্ধতিতে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মণ লবণ পাওয়া সম্ভব। করোনাকালীন সংকটে পাইলটিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আধুনিক পদ্ধতিতে দেশের লবণ চাষের রূপান্তর সময়সাপেক্ষ ও বড় বাজেটের প্রয়োজন। দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মিটিয়ে আমদানি কমিয়ে আনতে হলে আধুনিক পদ্ধতির সংযোজন জরুরি বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

বিসিক চট্টগ্রামের লবণ বিষয়ক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন, লবণ উৎপাদনে বিশেষায়িত জমির প্রয়োজন। দেশে লবণ চাষের বাড়তি জমি না থাকায় আধুনিক প্রযুক্তিতে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আগে উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদা সামঞ্জস্য থাকায় সনাতনী উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল। এখন সীমিত জমিতে বেশি লবণ উৎপাদন ছাড়া উপায় নেই। বিসিক এ ধরনের একাধিক প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close