শিল্প-বানিজ্য

শেল ব্যাংকের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: দেশ থেকে টাকা পাচারের নতুন রুটের সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। দেশের কয়েকটি ব্যাংক বেআইনিভাবে শেল ব্যাংকের (ব্যাংকে গ্রাহকের নাম-ঠিকানা ছাড়াই শুধু একটি কোড নম্বরের ভিত্তিতে হিসাব খুলে আমদানি-রফতানির সুযোগ) মাধ্যমে পণ্য রফতানি করে এ টাকা পাচার করেছে।

এ বিষয়ে আরও বিশদ তদন্ত করা হচ্ছে। একইসঙ্গে শেল ব্যাংকের মাধ্যমে যাতে কোনো টাকা পাচার করা না যায় সেজন্য ওইসব ব্যাংকের সঙ্গে সব ধরনের লেনদেন বন্ধ করার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

এছাড়া যেসব বাংলাদেশি নাগরিক রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন তাদের জীবন ধারণে ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যবহৃত অর্থের উৎস সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

একইসঙ্গে তাদের পেশা, বাসস্থান, বিলাসী জীবনযাপনের নেপথ্যের কারণসহ সব রকম তথ্য সংগ্রহে সরকারের একাধিক সংস্থার জোরালো তৎপরতা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস যৌথভাবে কাজ শুরু করেছে।

বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, শেল ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোনো অনুমোদন নেই। অনেক দেশেই নেই। কিছু দেশে আছে। সেগুলোতে যাতে কোনো লেনদেন করা না হয় সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, বিদেশে পাচার করা সম্পদ দেশে ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে- যেসব বাংলাদেশি নাগরিক রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে। এরই মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের যেসব নাগরিক রাজনৈতিক কারণে বিদেশে অবস্থান করছেন, তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। ওই তালিকা ধরে প্রাথমিক যোগাযোগের ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার পর এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়া হবে।

ইতিমধ্যে কিছু তথ্যের ভিত্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মিশনগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে চিঠি দেয়ার চেয়ে দ্বিপক্ষীয় আইনি সহযোগিতা চাওয়া অপেক্ষাকৃত বেশি কার্যকর হবে। এ প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সংশিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশে শেল ব্যাংকের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। তবে কিছু দেশে এর কার্যক্রম রয়েছে। যেসব দেশে লেনদেন নীতিমালা শিথিল, ওইসব দেশে-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে শেল ব্যাংক পরিচালনার অনুমতি রয়েছে। এমন কয়েকটি দেশের শেল ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক এলসির মাধ্যমে পণ্য রফতানি করেছে। যা বেআইনি। এখন এ বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, বিদেশে পাচার করা সম্পদ দেশে ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের সভায় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে যে সব তদন্তকারী সংস্থা থেকে মানি লন্ডারিং অপরাধের তদন্ত ও মামলা হচ্ছে না, সেসব সংস্থা তাদের কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্থাগুলোকে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থপাচার রোধে অধিকতর সজাগ থাকার বিষয়ে বাংলাদেশের সব ব্যাংককে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর আলোকে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে শেল ব্যাংকের মাধ্যমে যাতে কোনো ধরনের লেনদেন না হয়, সে বিষয়টির প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক শেল ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করেছে। এর বিপরীতে রফতানি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। বিএফআইইউ এ ধরনের বেশকিছু ঘটনা শনাক্ত করেছে। তাই মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণকারী সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শেল ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। এ নির্দেশনা যেসব দেশ মানবে না মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিষয়ক মানের অবনতি ঘটবে সেসব দেশের।

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকা পাচার বন্ধে করণীয় সম্পর্কে প্রতিটি ব্যাংকের বাণিজ্য বিভাগের প্রধানের মতামত নেয়া হয়েছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। অচিরেই এটি জারি করা হবে। এটি জরুরিভিত্তিতে বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এছাড়া বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস। এক্ষেত্রে ফৌজদারি মামলা করা যায় কিনা সে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে বিএফআইইউ সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারে। এ ব্যাপারে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গোয়েন্দা প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট সংস্থায় পাঠানো হয়। তারা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ  বলেন, বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। তা না হলে অর্থনীতির ক্ষতি হবে। এজন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের সতর্ক হতে হবে। বাণিজ্যের মাধ্যমে যেসব অর্থ পাচার হয় তা ব্যাংকাররা সতর্ক হলে বন্ধ করা সহজ হবে। পাশাপাশি কাস্টমস ও অন্য সংস্থাগুলোকেও সতর্ক হতে হবে। দেশ থেকে বর্তমানে যে অর্থ পাচার হচ্ছে তার একটি বড় অংশই যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন চেষ্টা সংক্রান্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ বা ডিটেনশনে নিলে তা অন্যান্য অপরাধীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, যা এ ধরনের অপরাধকে কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে। এ ধরনের কোনো অপরাধ শনাক্তের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে অবহিত করলে দ্রুত ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে। এ বিষয়ে টাস্কফোর্স সিদ্ধান্ত নিলে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে যেসব মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটে সেক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিএফআইইউ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা অ্যাটর্নি জেনারেলকে জানাতে পারে।

/এনএ

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close